Advertisement
১৬ এপ্রিল ২০২৪

শতবর্ষ প্রাচীন বাংলোকে ঘিরেই উদ্যোগ পর্যটনে

লেপচা ভাষায় কুয়াশা মানে তাকদা। আকাশ ছোঁয়া উঁচু উঁচু পা‌ইন গাছের জঙ্গল ঢেকে যায় সেই কুয়াশায়। ভিতর দিয়ে আঁকাবাকা পথ। উঁচু নিচু পাহাড়ের ঢাল ধরে নজর কাড়া সবুজ চা বাগিচার ঢাল। রাস্তার দুই ধারে সাদা, গোলাপি এবং হলুদ রঙের ধুতরো ফুলের সারি। বিকেল গড়াতেই সাদা তুলোর মত উড়ে এসে চারদিক আবছা হয়ে উঠেছে কুয়াশায়। কোনও কোনও সময় ঝিরিঝিরি বৃষ্টিতে পাথুরে রাস্তা ভিজে সারও হচ্ছে। এরই মধ্যে ছোট ছোট পাহাড়ের কোলে নজর পড়ছে শতাব্দী প্রাচীন বৃটিশ স্থাপত্যের নমুনা, পাথরের তৈরি ছোট-বড় বাংলো।

তাকদায় নতুনভাবে তৈরি হচ্ছে সোনপুর মহারাজার বাংলোটি। নিজস্ব চিত্র।

তাকদায় নতুনভাবে তৈরি হচ্ছে সোনপুর মহারাজার বাংলোটি। নিজস্ব চিত্র।

কৌশিক চৌধুরী
তাকদা (দার্জিলিং) শেষ আপডেট: ০৭ জুন ২০১৫ ০৩:০৭
Share: Save:

লেপচা ভাষায় কুয়াশা মানে তাকদা। আকাশ ছোঁয়া উঁচু উঁচু পা‌ইন গাছের জঙ্গল ঢেকে যায় সেই কুয়াশায়। ভিতর দিয়ে আঁকাবাকা পথ। উঁচু নিচু পাহাড়ের ঢাল ধরে নজর কাড়া সবুজ চা বাগিচার ঢাল। রাস্তার দুই ধারে সাদা, গোলাপি এবং হলুদ রঙের ধুতরো ফুলের সারি। বিকেল গড়াতেই সাদা তুলোর মত উড়ে এসে চারদিক আবছা হয়ে উঠেছে কুয়াশায়। কোনও কোনও সময় ঝিরিঝিরি বৃষ্টিতে পাথুরে রাস্তা ভিজে সারও হচ্ছে। এরই মধ্যে ছোট ছোট পাহাড়ের কোলে নজর পড়ছে শতাব্দী প্রাচীন বৃটিশ স্থাপত্যের নমুনা, পাথরের তৈরি ছোট-বড় বাংলো।

তার কোনওটার আবার নিচে রয়েছে বিশ্বযুদ্ধের সময়কার লুকনো ‘বাঙ্কারও। এখনও এককোণে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে রয়েছে ইউরোপিয়ান ক্লাব। একটু দূরেই রয়েছে এক সময়কার এশিয়ার সর্ববৃহৎ অর্কিড সেন্টারও। আর এর কিছুটা দূরত্বে এবড়ো থেবড়ো পাথুরে রাস্তা দিয়ে প্রায় ২০০ মিটার উঠলেই পাইনের জঙ্গলে ঢাকা পাহাড়ের মাথায় নজর কাড়বে ‘সোনপুর হাউস’। বিহারের প্রসিদ্ধ সোনপুর মহারাজার এক সময়কার ছুটি কাটানোর বাংলো। তথাকথিত রাজা, মহারাজাদের প্যালেসের আদল নয়, পুরোটাই ‘কলোনিয়াল’ স্থাপত্য।

তাই হয়তো, ১৯০০ সালের পর থেকে বৃটিশ উচ্চপদস্থ অফিসারদের অতি পছন্দের জায়গা হয়ে ওঠে সোনপুর হাউস। তার পর থেকে এলাকায় তৈরি হয়, একই রকম ছোটবড় মোট ১২টি বাংলো। ১৯১৫ সাল নাগাদ দার্জিলিং মহকুমার তাকদা সারা বিশ্বে পরিচিতি লাভ করে ‘বৃটিশ ক্যান্টনমেন্ট এরিয়া’ হিসাবেই।

কুয়াশায় ঢাকা এই জনপদের ইতিহাস পার হয়ে গিয়েছে ১০০ বছর। নানা টানাপড়েনের মধ্যে দিয়ে তাকদা এখন ছোট্ট পাহাড়ি জনপদ। ব্যতিক্রম সোনপুর হাউস। শতাব্দী প্রাচীন ওই মহারাজের বাংলোকে ঘিরেই নতুন করে তাকদাকে বিশ্ব পর্যটন মানচিত্রে জায়গা তৈরি করার প্রয়াস শুরু হয়েছে। ইতিমধ্যে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও তাকাদায় থেকেও গিয়েছেন। তিনিও এলাকাটি হেরিটেজ ট্যুরিজম সাইট হিসেবে গড়ে তোলার কথাও বলেছেন।

ইতিমধ্যে সোনপুর মহারাজার বাংলোটিকে নতুন করে সাজিয়ে তোলার কাজ শুরু হয়েছে। বৃটিশ এবং রাজ পরিবারের হাত ঘুরে সোনপুর হাউসটির মালিকানা এখন পযর্টনপ্রেমী নরবু জি লামার হাতে। তিনি আবার গোর্খা জনমুক্তি মোর্চার কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য তথা তাকদার গোর্খাল্যান্ড টেরিটোরিয়াল অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (জিটিএ) নির্বাচিত সদস্য।

নরবু লামার কথায়, ‘‘তাকদার ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি শতাব্দী প্রাচীন। নতুন করে এটা মানুষের সামনে তুলে ধরার কাজ শুরু করা হয়েছে। সোনপুর হাউসটিকে পুরানো আদলেই সংস্কার করা হচ্ছে। আপাতত বাংলোটিতে বাছাই করা অতিথিদেরই রাখা হচ্ছে।’’ তিনি জানান, এলাকার পুরানো বাংলোগুলির বেশিরভাগের মালিকানা এখন ব্যক্তিগত স্তরে রয়েছে। সেখানে হোমস্টের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। এতে বাংলোর মালিকদের কিছু আয় ছাড়াও রক্ষণাবেক্ষনের খরচও উঠবে। জিটিও থেকে এলাকার পরিকাঠামো উন্নয়ন করা হচ্ছে।

৩১-এ জাতীয় সড়ক দিয়ে গেলে রম্ভি হয়ে তিস্তা ভ্যালি এবং রংলি রংলিওট চা বাগান পার হলেও তাকদা। আবার কার্শিয়াং হয়ে জোড়বাংলো থেকেও তাকদা পৌঁছনো যায়। একসময় ঘোড়া সওয়ারি করেও সাহাবেরা এলাকায় গড়ে তোলেন বৃটিশ ‘কলোনি’। এমনকী, লোবস ডায়েরি ফার্ম, চকলেট কারাখানা, কেভেনটার্সের ডেয়ারিও তৈরি হয়। এশিয়ার অন্যতম সম্ভ্রান্ত গ্রাম হিসেবে তাকদা একসময় পরিচিতও ছিল। সব এখন ইতিহাস। এখন তাকদাকে কেন্দ্র করে পযর্টকেরা মংপু, তিনচুলে, লামাহাটা, ত্রিবেনী বা ছোট মঙয়ার মতো এলাকাগুলি ঘুরেও দেখতে পারেন। তেমনই, তাকদা গুম্ফা বা অসাধারণ সুন্দর কয়েকটি চা বাগানেও ঘুরতে পারেন। ঘন্টাখানেকের মধ্যে পৌঁছানো যায় শৈল শহর, দার্জিলিঙে।

তাকদা’র ১০০ বছরের ইতিহাসকে উদযাপন করতে সম্প্রতি তৈরি রয়েছে একটি কমিটিও। যাঁর অন্যতম উদ্যোক্তা রাজ বসু। তিনি বলেন, ‘‘প্রথমে সোনপুর হাউসটিকে তৈরি করা হচ্ছে। মূল রাস্তায় পুরনো আমলের আদলে বিশেষ গেটও তৈরি হবে। আরও কয়েকটি হোমস্টেও তৈরি হয়েছে। চা বাগান, ইতিহাস এবং ঘন কুয়াশায় ঢাকা তাকদা এক কথায় অনবদ্য। আমরা একটি উৎসবের পরিকল্পনাও নিয়েছি।’’

সরকারি স্তরে রাজ্য পযর্টন দফতর তরফে তাকদায় ২৫টি হোমস্টে তৈরি করাচ্ছে। সাজানো হচ্ছে প্রাচীন অর্কিড সেন্টারটিও। সব মিলিয়ে আপাতত ১ কোটি খরচও হচ্ছে বলেও সরকারি সূত্রের খবর। দফতরের ডিরেক্টর উমাপদ চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘‘আমরা বন দফতরকে টাকা দিচ্ছি। তাঁরাই সব কাজ করছেন।’’ তবে ইস্টার্ন হিমালয়া ট্রাভেন অ্যান্ড ট্যুর অপারের্টস অ্যাসোসিয়েশনের কার্যকরী সভাপতি সম্রাট সান্যাল বলেন, ‘‘বেসরকারি তো বটেই সরকারি স্তরে তাকদার আরও পরিকাঠামো উন্নয়ন এবং প্রচার দরকার। তা হলে তাকদা পযর্টন মানচিত্রে জোরালো ভাবে ঠাঁই পাবে।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE