Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

পুরনো ছবি সংরক্ষণের ব্যবস্থা নেই, আক্ষেপ শহরে

সেই আমলে বিশি‌ষ্ট জন, বিখ্যাত রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বরা শিলিগুড়িতে পৌঁছলে গোড়ায় শান্তিবাবু ছিলেন সকলের ছবি তোলার অন্যতম ভরসা। প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু বাগডোগরায় পৌঁছলেও ছবি তোলার জন্য ঢাক পড়ত তাঁর। পুরানো সেই দিনের ছবি আজও আগলে রেখেছেন গৌরীশঙ্কর ভট্টাচার্যের মতো অনেকেই। পরে অবশ্য আরও অনেকে ধীরে ধীরে তৈরি হন।

আশির দশকে শিলিগুড়ি শহর। পুরনো শিলিগুড়ির ছবি বিশ্বরূপ বসাকের সংগ্রহ থেকে।

আশির দশকে শিলিগুড়ি শহর। পুরনো শিলিগুড়ির ছবি বিশ্বরূপ বসাকের সংগ্রহ থেকে।

কিশোর সাহা
কোচবিহার শেষ আপডেট: ১৮ অগস্ট ২০১৫ ০৩:০৩
Share: Save:

সেই আমলে বিশি‌ষ্ট জন, বিখ্যাত রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বরা শিলিগুড়িতে পৌঁছলে গোড়ায় শান্তিবাবু ছিলেন সকলের ছবি তোলার অন্যতম ভরসা। প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু বাগডোগরায় পৌঁছলেও ছবি তোলার জন্য ঢাক পড়ত তাঁর। পুরানো সেই দিনের ছবি আজও আগলে রেখেছেন গৌরীশঙ্কর ভট্টাচার্যের মতো অনেকেই। পরে অবশ্য আরও অনেকে ধীরে ধীরে তৈরি হন। মলিনা স্টু়ডিও, টেকনিসিয়ান স্টুডিও, বসাক স্টুডিও, কৃষ্ণা স্টুডিও, ম্যাডোনা স্টুডিও, এইচ এল স্টুডিও, ইলোরা স্টুডিও, সোনা স্টুডিও সহ একাধিক জায়গায় ছবি তোলানোর বন্দোবস্ত হয়। ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে ফটোগ্রাফিক সোসাইটি।
সত্তরের দশকের গোড়ায় অবশ্য শিলিগুড়ির ছবি তোলানোর আদব-কায়দা বদলাতে শুরু করে। ততদিনে অপেক্ষাকৃত আধুনিক ক্যামেরা পৌঁছে গিয়েছে শিলিগুড়িতেও। সেই দশকের শেষার্ধে অ্যাডভেঞ্চার প্রেমী একদল যুবক ‘ফটোগ্রাফি’র দিকে ঝুঁকে পড়েছিলেন। প্রবীণ আলোকচিত্রীদের অনেকেই জানান, ততদিনে হরেন দত্ত, উপেন দাশগুপ্তদের যুগ পেরিয়ে শিলিগুড়ির ছবির দুনিয়ায় তরুণ দাসের মতো দক্ষ আলোকচিত্রীর নাম ছড়িয়ে পড়েছে। সত্তরের দশকের শেষে ছবি তোলার দিকে ঢুঁকেছিলেন পরিবেশপ্রেমী অনিমেষ বসুও। বর্থমানে বিমালয়ান নেচার অ্যান্ড অ্যা়ভেঞ্চার ফাউন্ডেশনের অন্যতম কর্মকর্তা অনিমেষবাবু সেই আমলে দেশের নানা এলাকার ফটোগ্রাফি প্রতিযোগিতা অংশ নিয়ে এক বছরে ৬টি পুরস্কার পেয়েছিলেন। যা কি না তৎকালীন সময়ে উত্তরবঙ্গে নজিরবিহীন ঘটনা হিসেবে এখনও ফটোগ্রাফির দুনিয়ায় আলোচনা হয়ে থাকে। অনিমেষবাবু বলেন, ‘‘শিলিগুড়িতে ছবির দুনিয়ায় শান্তি সিংহের অবদান উল্লেখযোগ্য। তিনি সারা জীবন ফটোগ্রাফি নিয়েই মেতে ছিলেন। জীবনে যা ধনসম্পত্তি অর্জন করেছিলেন, সবই ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘকে দান করে দিয়ে গিয়েছেন। এমন বড় মাপের মানুষ মেলা দুর্লভ।’’

তবে আশির দশকের মাঝামাঝি সময়ে শিলিগুড়ির ছবির চেহারা ক্রমশ বদলে যেতে থাকে। সাদা-কালোকে ছাপিয়ে রঙিন হয়ে ওঠে সেই দুনিয়া। নব্বইয়ের দশকে শহরের ইতিউতি গজিয়ে ওঠে রকমারি কালার ল্যাবরেটরি। এখন তো সেবক রোডের একটি কালার ল্যাবরেটরিতে নিয়মিত আগ্রহীদের ফটোগ্রাফি কোর্স করানোর ব্যবস্থা রয়েছে।

শিলিগুড়ির ফটোগ্রাফারদের একাধিক সংগঠনও হয়েছে। অনেকের কাছেই পুরানো শিলিগুড়ির ছবি রয়েছে। কারও কাছে রয়েছে অতীতের তিলক ময়দান যা কি না এখন কাঞ্চনজঙ্ঘা স্টেডিয়ামের ছবি রয়েছে। কারও কাছে রয়েছে সিলিগুড়ি থানার উল্টোদিকের সেই কাঠের দোতলা বাড়ি। অথবা শালকাঠের খুঁটির উপরে গড়ে ওঠা শিলিগুড়ির সেই থানার ছবিও রয়েছে কারও সংগ্রহে। অথচ, সেই সব ছবি নিয়ে শিলিগুড়ির ঐতিহ্য সংরক্ষণের জন্য সরকারি তরফে আজও কেউ উদ্যোগী হননি। বাম আমলে যুব উৎসব, শিলিগুড়ি উৎসব করে বহু টাকা খরচ হলেও এ সব নিয়ে চিন্তাভাবনা হয়েছে বলে শহরপ্রেমীরা অনেকেই মনে করতে পারছেন না। তৃণমূল জমানায় ফি বছর কয়েক কোটি টাকা খরচ করে উত্তরবঙ্গ উৎসব কিংবা হালে শিলিগুড়ি কার্নিভাল হলেও শহরের পুরানো ছবি ঘষেমেজে, সংস্কার করে তা এক জায়গায় জড়ো করে স্থায়ী প্রদর্শনীর ব্যাপারে এখনও সরকারি তরফে কেউই উদ্যোগী হননি কেন তা নিয়েই শহরের নানা মহলে আক্ষেপ রয়েছে।

অবশ্য বেসরকারি উদ্যোগে শিলিগুড়ি হেরিটেজ সোসাইটি গড়ার প্রক্রিয়া শুরু হওয়ায় আশার আলো দেখছেন অনেকেই। ইতিমধ্যেই ওই সোসাইটি গড়তে উদ্যোগীরা শহরের বিশিষ্ট জনদের কাছ থেকে পুরনো ছবি সংরক্ষণের প্রক্রিয়ায় নেমেছেন। উদ্যোক্তারা সাহায্য নিচ্ছেন এখনকার কর্মরত পেশাদার ফটোগ্রাফারদেরও। এখন নানা সংবাদ মাধ্যমে কর্মরত ফটোগ্রাফার, ক্যামেরাম্যানের সংখ্যাও খুব কম নয়। শিলিগুড়ি ও লাগোয়া এলাকা মিলে অন্তত ১০০ জন সরাসরি ফটোগ্রাফির পেশায় যুক্ত। যাঁদের অনেকেই যথেষ্ট ভাল ছবি তোলার কাজ করে চলেছেন।

উপরন্তু, নানা পেশার বিশিষ্টজনরাও ওই উদ্যোগে সামিল হয়েছেন। যেমন, সাবেক শিলিগুড়ির ‘গর্বিত মুহূর্ত’-এর ছবির প্রসঙ্গে শিলিগুড়ি আদালতের আইনজীবী রতন বণিক বলেছেন, ‘‘একটা সময়ে আমরা শিলিগুড়ি বার অ্যাসোসিয়েশনের শত বর্ষ পূর্তি পালন করেছি। সেই সময়ে অনেক পুরানো তথ্য, ছবি জোগাড় হয়েছে। তাতে যেমন রয়েছে শিলিগুড়ির বিশিষ্ট আইনজীবী ও পরে কলকাতা ও সাবেক মুম্বই হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি আনন্দময় ভট্টাচার্যের কিছু বিরল মুহূর্তের ছবি। রয়েছে আদালতের আইনজীবীদের নানা গ্রুপ ফটোও। শিলিগুড়ি হেরিটেজ সোসাইটি গড়ে উঠলে আমরাও সবরকম সহযোগিতা করব।’’ ঠিক তেমনই, শিলিগুড়ির প্রবীণ চিকিৎসক, ইঞ্জিনিয়র, অবসরপ্রাপ্ত সরকারি অফিসার-কর্মী, কবি-লেখক-গবেষকও চাইছেন শহরের শতবর্ষে যথাসম্ভব ছবি সংরক্ষণের ব্যবস্থা হোক।

ফলে সরকারি তরফে উদ্যোগ না হলেও নানা পেশার আগ্রহীদের সৌজন্যে পুরনো শিলিগুড়ির ছবি নিয়ে অদূর ভবিষ্যতে সংগ্রহশালা হবেই। এটা নিয়ে শহরপ্রেমীদের মধ্যে খুব একটা সংশয় নেই।

এই সংক্রান্ত ফোটো গ্যালারি

শিলিগুড়ির পুরনো ছবি

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

kishor saha siliguri picture camera
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE