সেবকে রীতিমতো পাঁচিল দিয়ে এ ভাবেই দখল করা হচ্ছে তিস্তার চর। গজিয়ে উঠছে বাড়ি। ছবি : সন্দীপ পাল
ভোটের কাজে এখন ব্যস্ত সবাই। আর সেই সুযোগে শিলিগুড়ির উপকণ্ঠে সেবকে তিস্তার চর প্লট করে বিক্রি হয়ে যাচ্ছে রোজই। সেবক বাজারে সেই চরের দাম ৫ লক্ষ টাকা পর্যন্ত উঠে গিয়েছে। জমি-মাফিয়ারা এতটাই বেপরোয়া যে, তিস্তার বুকেই সেচ দফতরের বাঁধ বরাবর পাঁচিল দিয়ে ঘিরে ভিতরে টিনের চাল দিয়ে ঘরও তৈরি করে ফেলা হয়েছে।
সব দেখেশুনেও এলাকার নেতা-কর্তাদের অধিকাংশই হাত গুটিয়ে বসে বলে অভিযোগ। কিন্তু, তিস্তাপাড়ের বাতাসে ভাসছে রাসি রাশি টাকা ওড়ার কথাও। ভোটের বাজারে টাকা ছড়িয়ে তিস্তা দখল করে পাঁচিল, ঘরদোর তৈরি হচ্ছে বলে সরাসরি নির্বাচন কমিশনের কাছে অভিযোগ পৌঁচেছে। দার্জিলিঙের জেলাশাসক অনুরাগ শ্রীবাস্তব বলেছেন, ‘‘সেবকে তিস্তার চর দখলের অভিযোগ নিয়ে তদন্ত হচ্ছে। রিপোর্ট পেলেই কড়া পদক্ষেপ করা হবে।’’
কয়েকজন স্থানীয় ব্যবসায়ীর অভিযোগ, পুলিশ-প্রশাসন, সেচ দফতরের একাংশের মদত ছাড়া ভোটের সময়ে এমন ঝড়ের গতিতে নানা বেআইনি নির্মাণ হতে পারে না। যে ব্যবসায়ীরা রিসর্ট বানাতে আসরে নেমেছেন, তাঁদের নাম-ধাম-ঠিকানাও এলাকার কেউ দিতে পারছেন না। জমি মাফিয়ারা চাউর করে দিয়েছে, একবার ঘরদোর তৈরি করতে পারলে ভোটের পরে কেউ তা ভাঙার সাহস পাবে না। সেবকের হোটেলে, চায়ের দোকানে কান পাতলেই শোনা যাচ্ছে, উচ্ছেদের চেষ্টা হলে আন্দোলনের জন্যও নাকি প্রস্তুত জমি মাফিয়ারা।
সেবক বাজারের অনেকেই জানিয়েছেন, দিল্লি, বিহারের কয়েক জন জমি মাফিয়াকে ওই এলাকায় নিয়মিত রাতের পানভোজনের আসরে দেখা যায়। তাঁদের সন্দেহ, স্থানীয় ব্যবসায়ী ও বাসিন্দাদের একাংশও মদত দিচ্ছেন বলে ভিন রাজ্যের জমি মাফিয়ারা তিস্তার চরে জাঁকিয়ে বসার চেষ্টা করছে।
কী বলছেন রাজনীতিকেরা? গোর্খা জনমুক্তি মোর্চার নেতা তথা এলাকার জিটিএ সদস্য কল্যাণ দেওয়ানের দাবি, তাঁরা কিছুই জানেন না। মোর্চার সাধারণ সম্পাদক তথা জিটিএ-র সদস্য রোশন গিরি কিন্তু বলেন, ‘‘ভোটের সময়ে টাকা ছড়িয়ে তিস্তার চরে রিসর্ট বানানোর চেষ্টা হচ্ছে? এটা কোনও মতেই হতে দেব না। সব ভাঙতে হবে।’’ তৃণমূলের পাহাড় কমিটির অন্যতম নেতা বিন্নি শর্মা বলেন, ‘‘তিস্তার চর দখল হলে মোর্চাকেই জবাবদিহি করতে হবে।’’ কিন্তু শাসক দলের নেতা বিন্নিবাবুরা কেন সক্রিয় হচ্ছেন না? বিন্নির জবাব, ‘‘প্রশাসনের নানা স্তরে বিষয়টি জানিয়ে পদক্ষেপ করতে অনুরোধ করেছি।’’
এই দেখছি দেখব ভাবের মধ্যেই সেবক বাজারের পেট্রোল পাম্প থেকে রেলগেট লাগোয়া এলাকায় তিস্তার চর ও নদীবক্ষ দখলের প্রতিযোগিতা যেন চরমে উঠেছে। তিস্তার স্পারের গা ঘেঁষে ছোট্ট একচালা ঘরের দাম উঠেছে ৭ লক্ষ টাকা। নদীর চরে বাঁধের গা ছুঁয়ে কাঠা প্রতি জমির দামও ৪-৫ লক্ষ টাকা। কোনও নথিপত্র ছাড়া জমি কিনে শেষ অবধি সব জলে যাবে না তো! এই প্রশ্নে কয়েকজন স্থানীয় ব্যবসায়ী হেসে উঠলেন। তাঁদের যুক্তি, ‘‘ভোটের সময়ে বেআইনি নির্মাণ ভাঙতে পুলিশ-প্রশাসন কোনও অভিযান করে না। তাই একবার বানানো হয়ে গেলে উচ্ছেদ বিরোধী আন্দোলনও করা যাবে। তখন পুনর্বাসন ছাড়া কেউ ঘরদোর ভাঙতে পারবে না। সে জন্যই সাহস করছেন ভিনরাজ্যের ব্যবসায়ীরা।’’
যে ব্যবসায়ীরা তিস্তা দখলের জন্য বিনিয়োগ করছেন, তাঁদের দেখা মেলেনি। ওই এলাকায় বানানো ঘরদোরের তদারকিতে থাকা চৌকিদার বললেন, ‘‘মালিক রিসর্টের ট্রেড লাইসেন্স চেয়ে আবেদন করেছেন।’’ বহুবার অনুরোধ করলেও মালিকের নাম জানাতে চাননি ওই প্রবীণ চৌকিদার।
নদীবক্ষ কিংবা বাঁধের জমি দখল হলে আসরে নামার কথা সেচ দফতরেরও। কিন্তু সেচ দফতরের জলপাইগুড়ি বিভাগের কয়েক জন কর্মী জানান, ভোটের কাজে ব্যস্ত থাকায় অভিযোগ পেলেও সেখানে যেতে পারেননি। সেচ দফতরের এগজিকিউটিভ ইঞ্জিনিয়র জয়প্রকাশ পাণ্ডে বলেন, ‘‘বিষয়টি নিয়ে বিশদে খোঁজখবরের নির্দেশ দিয়েছি।’’
হিমালয়ান নেচার অ্যান্ড অ্যাডভেঞ্চার ফাউন্ডেশনের (ন্যাফ) কো-অর্ডিনেটর অনিমেষ বসু উদ্বিগ্ন। তিনি বলেন, ‘‘বিরাট ষড়যন্ত্র বলে মনে হচ্ছে। আমরা আলোচনা করে পদক্ষেপ করব।’’ উচ্চ আদালতের গ্রিন বেঞ্চের হস্তক্ষেপ চাইবেন বলে জানিয়েছেন পরিবেশপ্রেমী সুভাষ দত্ত। তিনি বলেন, ‘‘ভোট বলে বেআইনি নির্মাণ ভাঙার অভিযান হবে না, সেটা হতে পারে না। ভিডিও ফুটেজ সংগ্রহ করে হাইকোর্টের গ্রিন বেঞ্চে জমা দেব।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy