Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

পর্যটনের মসলা যথেষ্ট, কিন্তু রান্না চাপেনি

শুধু যাতায়াতের পথের ধারের একটি শহর না হয়ে থেকে, দেশ-বিদেশের পর্যটকদের আকর্ষণ করার যথেষ্ট ক্ষমতাও কিন্তু শিলিগুড়ির রয়েছে। কয়েক কিলোমিটার গেলেই বাংলাদেশ। নেপাল পৌঁছতে লাগবে বড় জোর ঘণ্টাখানেক। হাতের তাছেই অভয়ারণ্য। নদী-পাহাড়ও।

ফুলবাড়ি-শিলিগুড়ির পথে পর্যটন গড়ার প্রকল্প নেওয়ার আর্জি জানানো হয়েছে। ছবি: বিশ্বরূপ বসাক।

ফুলবাড়ি-শিলিগুড়ির পথে পর্যটন গড়ার প্রকল্প নেওয়ার আর্জি জানানো হয়েছে। ছবি: বিশ্বরূপ বসাক।

কিশোর সাহা
শিলিগুড়ি শেষ আপডেট: ২৭ জুলাই ২০১৫ ০২:০৫
Share: Save:

শুধু যাতায়াতের পথের ধারের একটি শহর না হয়ে থেকে, দেশ-বিদেশের পর্যটকদের আকর্ষণ করার যথেষ্ট ক্ষমতাও কিন্তু শিলিগুড়ির রয়েছে।

কয়েক কিলোমিটার গেলেই বাংলাদেশ। নেপাল পৌঁছতে লাগবে বড় জোর ঘণ্টাখানেক। হাতের তাছেই অভয়ারণ্য। নদী-পাহাড়ও। কোথাও তিব্বতীদের ধর্মগুরু দলাই লামার উদ্বোধন করে যাওয়া সুদৃশ্য বৌদ্ধ গুম্ফা। কয়েক কিলোমিটার দূরে তিস্তার ধারে পাহাড় চূড়ায় প্রাচীন কালীমন্দির। শহরের প্রায় কেন্দ্রস্থলে ঝকঝকে ঐতিহ্যমণ্ডিত মসজিদ, একাধিক প্রাচীন চার্চ, গুরুদ্বার। আরও কত কিছু! এমন ভৌগোলিক অবস্থান সত্ত্বেও এখনও শিলিগুড়ি পর্যটকদের যাতায়াতের পথে ‘একটু থামা’র জায়গা হিসেবেই যেন পরিচিত। সরকারি কিংবা বেসরকারি কোনও তরফেই শিলিগুড়িকে পর্যটকদের গন্তব্য করে তোলার সক্রিয় কোনও চেষ্টা দেখা যাচ্ছে না বলে হতাশা ও ক্ষোভ বাড়ছে শহরেই।

সরকারি তরফে অবশ্য এখন দাবি করা হচ্ছে, শিলিগুড়ির উপকণ্ঠে সরিয়া পার্কে মুক্ত চিড়িয়াখানা গড়ে তোলার কাজ জোরকদমে চলছে। চলছে শিলিগুড়ির অদূরে জলপাইগুড়ির গজলডোবায় বড় মাপের পর্যটন প্রকল্প গড়ার প্রক্রিয়াও। সুকনা থেকে সরিয়া হয়ে গজলডোবা পর্যন্ত জঙ্গল-পথে বেড়ানোর পরিকল্পনার কথাও সরকারের পক্ষে জানানো হচ্ছে। উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রী গৌতম দেবও বারেবারেই সরিয়া ও গজলডোবার প্রকল্প সম্পূর্ণ হলে কী ভাবে এলাকার পর্যটন মানচিত্র পাল্টে যাবে সে কথা বারেবারেই দাবি করছেন।

কিন্তু, শহরবাসীদের অনেকের আলোচনায় শোনা যাচ্ছে ভিন্ন সুর। শিলিগুড়ির বিদ্বজ্জনদের অনেকেরই মত, পর্যটকেরা যাতে শিলিগুড়ি ছুঁয়েই চলে না যান, সেটা নিশ্চিত না করলে এলাকার কর্মসংস্থানের সুযোগ তেমন বাড়বে না। তাই শহরের লাগোয়া এলাকায় যে চা বাগান, নদী, বনাঞ্চল রয়েছে সেখানে পর্যটকদের থাকার সুযোগ আরও তৈরির জন্য উদ্যোগী হওয়া জরুরি বলে মনে করেন শিলিগুড়ির বিশিষ্টজনদের অনেকেই। উত্তরবঙ্গ, সিকিম সহ বিস্তীর্ণ এলাকার পর্যটনের প্রসারে দীর্ঘদিন ধরে যুক্তদেরও মত, শিলিগুড়িকে কেন্দ্র করে বহুমুখী পরিকল্পনা নেওয়া যেতে পারে।

সেই পরিকল্পনার প্রথমেই রয়েছে, সীমান্ত ভ্রমণের পরিকাঠামোর তৈরির উপরে জোর দিতে হবে। শিলিগুড়ি থেকে নেপাল সীমান্তের নকশালবাড়ি বেশি দূরে নয়। মেচি নদী পেরোলেই কাঁকরভিটা। এখন সীমান্তে কড়াকড়ি একটু বেশি হলেও বিনা পাসপোর্টে নেপালের কাঁকরভিটা গিয়ে সেখানে ধূলাবাড়ির বাজারে যাওয়া যায়। শিলিগুড়ি থেকে নেপালে গিয়ে ফিরে আসার পথে পানিঘাটা পেরিয়ে কলাবাড়ির জঙ্গলেও কিছুটা সময় কাটানোর ব্যবস্থা করা যেতে পারে।

শিলিগুড়ি গা গেঁষে প্রায় ১২ কিলোমিটারের মধ্যেই রয়েছে বাংলাদেশ সীমান্ত। ফুলবাড়ির কাছে বাংলাবান্ধা চেক পোস্ট দিয়ে এখন পণ্যবাহী গাড়ি যাতায়াত করে থাকে। আগামী দিনে চ্যাংরাবান্ধা সীমান্তের মতো বাংলাবান্ধা দিয়েও পাসপোর্টধারীরা যাতায়াত করতে পারবেন। শিলিগুড়িতে পর্যটকদের ধরে রাখতে ফুলবাড়ি-শিলিগুড়ির পথে যৌথ উদ্যোগে পর্যটন পরিকাঠামো গড়ার প্রকল্প দ্রুত হাতে নেওয়ার আর্জি জানিয়েছে পর্যটন মহল।

দ্বিতীয়ত, চা-পর্যটনের মেলবন্ধনের সুযোগ নিতে পারে শিলিগুড়ি শহরও। শহরের উপকণ্ঠে চাঁদমণি চা বাগানের জায়গায় গড়ে উঠেছে সিটি সেন্টার। উত্তরায়ণ উপনগরী। কাছেই রয়েছে মোহরগাঁও-গুলমা চা বাগান। নিউ চামটা সহ অন্তত ২১ টি ছোট-বড়-মাঝারি চা বাগান রয়েছে শিলিগুড়ি মহকুমার মধ্যেই। বেশ কয়েকটি চা বাগানে রয়েছে সুদৃশ্য বাংলো। চা বাগানগুলিকে কেন্দ্র করে পর্যটন পরিকাঠামো গড়লে শিলিগুড়ি শহরে দেশ-বিদেশের পর্যটকদের টানা সম্ভব বলে মনে করেন পর্যটন ব্যবসায়ীরা। শিলিগুড়ি শহরের আশেপাশের কোনও সরকারি জায়গায় একটি ‘চা-মিউজিয়ম’ গড়ার আর্জিও বহুদিন ধরে জানাচ্ছেন পর্যটন ব্যবসায়ীরা। যেখানে চায়ের নার্সারি থেকে চা তৈরি, প্যাকেজিংয়ের প্রক্রিয়া দেখানো হবে। সেখানে ‘স্যুভেনির স্টল’ও তৈরি হতে পারে। যেখানে মিলবে বাগানের দরে নানা স্বাদের চা। সেখানে চায়ের পেয়ালা বসে চুমক দেওয়ার মতো খোলামেলা রেস্তোরাঁ তৈরির ভাবনাও পরিকল্পনায় থাকা জরুরি।

তৃতীয়ত, আরও একটি বিষয়ে জোর দেওয়া দরকার বলে মনে করে পর্যটন মহল। তা হল, শিলিগুড়ি ও লাগোয়া এলাকার ধর্মীয় স্থানগুলিকে সামনে রেখেও পর্যটকদের আকৃষ্ট করতে হবে। কারণ, শিলিগুড়ির উপকণ্ঠে সালুগাড়ায় রয়েছে দু-দুটি মনোরম গুম্ফা। তিব্বতীদের ধর্মগুরু দলাই লামাও একাধিকবার যেখানে এসেছেন। সেবক রোডে রয়েছে সুদৃশ্য গুরুদ্বার। রয়ছে একাধিক প্রাচীন মসজিদ, চার্চও। শিলিগুড়ি শহরের উপকণ্ঠে বৈকুণ্ঠপুর বনাঞ্চল লাগোয়া বোঁদাগঞ্জ এলাকায় রয়েছে ভ্রামরী দেবীর মন্দির। নদী-পাহাড়-বন ঘরুরিয়ে দেখানোর ফাঁকে একাধিক ধর্মস্থান দেখানোর রেওয়াজ রয়েছে দেশ-বিদেশের পর্যটন কেন্দ্রে। সেটা মাথায় রেখে শিলিগুড়িতেও দিনভর বাতানুকূল বাসে বেড়ানো, নিরিবিল কোনও জায়গায় ঘন্টা দুয়েক বিশ্রাম, পান-ভোজনের ব্যবস্থা করা যেতে পারে।

উত্তরবঙ্গ, সিকিম, ভুটানের পর্যটন প্রসারের সঙ্গে বহু বছর ধরে যুক্ত রয়েছেন রাজ বসু। তিনি শিলিগুড়ির অবস্থানগত গুরুত্বের কথা উল্লেখ করে বলেন, ‘‘শিলিগুড়ি একটু ছুঁয়ে যাওয়ার জায়গা হিসেবেই এখনও পর্যটন মহলে পরিচিত। ‘করিডর’ হিসেবেই পরিচিত ‘ট্যুরিজম সার্কিটে’। কিন্তু, শিলিগুড়ি পুরোপুরি ‘ট্যুরিস্ট ডেস্টিনেশন’ হওয়ার মতো যথার্থ জায়গা। নেপাল ও বাংলাদেশ সীমান্ত, চা বাগান, নানা ঐতিহ্যমন্ডিত ধর্মস্থান রয়েছে। এ সব সামনে রেখে পরিকল্পনা তৈরি হলেই শিলিগুড়ি হয়ে উঠবে পর্যটকদের গন্তব্য। এটা বর্তমান সরকারকে গুরুত্ব সহকারে ভাবতে হবে। বেসরকারি উদ্যোগীদেরও সেই উদ্যোগে সামিল হতে হবে।’’ অবশ্য চিন্তাভাবনা শুরু হয়েছে অনেক মহলেই।

অর্থাৎ, পর্যটকদের আকর্ষণ করার মসলা রয়েছে যথেষ্টই। কিন্তু পরিবেশন কবে হবে, কেমন ভাবে হবে, তা নিয়ে দুশ্চিন্তা কাটছে না। কারণ, রান্না‌ই যে চাপেনি এখনও।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE