Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

দুর্লভ প্রত্ন সামগ্রী ছড়িয়ে আছে বরাভূমে

রুক্ষ মাটি। দূরে আকাশে মুখ তুলে অযোধ্যা পাহাড়। ছড়িয়ে রয়েছে ছোট-ছোট টিলা। এই এলাকায় একসময়ে ছিল বরাভূম রাজাদের রাজ্যপাট। সে ইতিহাসের অনেকটাই এখনও অনালোকিত। ঝাড়খণ্ড সীমানা ঘেঁষা জঙ্গলমহলের এই জনপদের নিকটবর্তী রেলস্টেশন ‘বরাভূম’ সেই রাজবংশকে স্মরণ করেই নামকরণ করা হয়।

অযত্নে এ ভাবেই নষ্ট হচ্ছে দুর্মূল্য সম্পদ। ছবি: সুজিত মাহাতো।

অযত্নে এ ভাবেই নষ্ট হচ্ছে দুর্মূল্য সম্পদ। ছবি: সুজিত মাহাতো।

প্রশান্ত পাল
বলরামপুর শেষ আপডেট: ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ ০০:২৩
Share: Save:

রুক্ষ মাটি। দূরে আকাশে মুখ তুলে অযোধ্যা পাহাড়। ছড়িয়ে রয়েছে ছোট-ছোট টিলা। এই এলাকায় একসময়ে ছিল বরাভূম রাজাদের রাজ্যপাট। সে ইতিহাসের অনেকটাই এখনও অনালোকিত।

ঝাড়খণ্ড সীমানা ঘেঁষা জঙ্গলমহলের এই জনপদের নিকটবর্তী রেলস্টেশন ‘বরাভূম’ সেই রাজবংশকে স্মরণ করেই নামকরণ করা হয়। গবেষকরা জানাচ্ছেন, আনুমানিক সপ্তম শতাব্দীর সময়ে বলরামপুরের বাঁশগড় গ্রামে বরাভূম রাজবংশের রাজধানী স্থাপন করা হয়। তবে কতদিন এই রাজবংশ এখানে রাজত্ব করেছিল সে সম্পর্কে কোনও সুনির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া যায় না। পরবর্তীকালে এই রাজবংশ তাদের রাজধানী বলরামপুর লাগোয়া বরাবাজারে স্থানান্তরিত করে।

এক সময়ে বলরামপুর ছিল বরাভূম পরগনার অধীনে। তখন ভূমিজ জাতির মানুষেরা সুবর্ণরেখার তীর এলাকা ধরে বিভিন্ন এলাকায় বসতি গড়ে তুলতে শুরু করেন। বলরামপুরে কোল জাতি সম্প্রদায়ভুক্ত ভূমিজরা বসতি স্থাপন করে। জেলার বিশিষ্ট লোক গবেষক দিলীপকুমার গোস্বামীর কথায়, “চৌকিদার, দফাদার, দিগারির কাজ ভূমিজদের দেওয়া হয়েছিল।” বলরামপুরের অদূরে শাসনডি গ্রামটিতে ভূমিজদের প্রাচীন সমাধিস্থান রয়েছে। এই গ্রামের বাসিন্দা ভরত সিংহ পাতর জানিয়েছেন, শুধু এই এলাকা থেকেই নয়, লাগোয়া বিহার বা ওড়িশা কিংবা আরও দূরবর্তী জায়গা থেকেও ভূমিজ সম্প্রদায়ের লোকজন এখনও এই গ্রামে মৃত নিকটাত্মীয়দের হাড় পুঁততে. আসেন। পাথরের গায়ে স্বর্গত নিকটাত্মীয়ের নাম লিখে পরম্পরা অনুযায়ী তা পুঁতে রাখা হাড়ের উপরে চাপা দেন তাঁরা। দিলীপবাবুর মতে, এ থেকে অনুমান করা যায় এই শাসনডিই ছিল এই জনগোষ্ঠীর আদি বাসস্থান।

পুরুলিয়ার বিভিন্ন জনপদে যেমন জৈন সভ্যতার নির্দশন পাওয়া গিয়েছে, বরাভূম বা বলরামপুরও তার ব্যতিক্রম নয়। শাসনডি গ্রামেই একটি গাছের নীচে আজও একটি মূর্তি রয়েছে। বলরামপুর কলেজের ইতিহাস বিষয়ের শিক্ষক শিবশঙ্কর সিংয়ের দাবি, “তিন ফুট তিন ইঞ্চি লম্বা ও এক ফুট আট ইঞ্চি চওড়া এই মূর্তিটি জৈন তীর্থঙ্কর ঋষভনাথের। কালো ক্লোরাইট জাতীয় পাথরে তৈরি মূর্তিটি কায়ৌতসর্গ মূদ্রায় দণ্ডায়মান। মূর্তির নীচের দিকে নৃত্যরত পরিচারিকার মূর্তি খোদাই করা রয়েছে। মূর্তিটি আনুমানিক নবম বা দশম শতাব্দীর।” তিনি জানান, তবে স্থানীয়রা বর্তমানে মূর্তিটি স্থানীয় লৌকিক দেবতা বুরু-ঠাকুর হিসেবে পুজো করেন। মাঘ মাসে মূর্তিটির পুজো হয়, মেলাও বসে। জেলার আর এক বিশিষ্ট প্রত্ন গবেষক সুভাষ রায়ের কথায়, “বাঁশগড়ে যেখানে বরাভূম রাজবংশ রাজধানী স্থাপন করেছিল বলে জানা যায় সেখানেও একটি ঋষভনাথের মূর্তির সন্ধান মিলেছে। এই মূর্তিটির নির্মাণশৈলী জেলার অন্য মূর্তিগুলির মতোই। দু’পাশে ২৪ তীর্থঙ্করের মূর্তি রয়েছে। উপরে মালা হাতে গন্ধব-গান্ধবী। নীচে দু’জন চামরধারী এবং ষাঁড় রয়েছে। পদ্মের উপরে কায়ৌতসর্গ মুদ্রায় দণ্ডায়মান। খোদিত রয়েছে ধ্যানরতা দুই রমনী ও দু’টি সিংহ মূর্তি।

গ্রামবাসী জানান, এলাকায় এ রকম ছোটবড় আরও অনেক মূর্তি ছিল কয়েকবছর আগেও। কিন্তু সে সবের হদিস এখন নেই। শিবশঙ্করবাবু জানান, বলরামপুরের শিরগি (শিরিঙ্গি) গ্রামেও নদীর ধারে একটি জৈন মূর্তি পড়ে থাকতে দেখেছিলেন পুরনো লোকজন। এখন সেই মূর্তির হদিস নেই। গ্রামের প্রান্তে পলাশগাছের নীচে প্রস্তর নির্মিত জৈন পট পড়ে রয়েছে। তাতে জৈন তীর্থঙ্করের মূর্তি খোদাই করা রয়েছে। এখানে পাথরের দেউলের ভগ্নাংবশেষ পড়ে রয়েছে। যেটুকু জানা যায়, তখন এখানকার রাজারা জৈন ধর্মে দীক্ষা নিয়েছিলেন। ফলে সেই নির্দশন এখনও এলাকার বিভিন্ন গ্রামে পড়ে রয়েছে অনাদরে ও অবহেলায়।” স্থানীয় স্কুলশিক্ষক দীপক মহান্তির আশঙ্কা, শাসনডি গ্রামের মূর্তিটি বেশ কয়েক বছর আগে চুরির চেষ্টা হয়েছিল। এ ভাবেই বাকি মূর্তিগুলিও হয়তো হারিয়ে যাবে। নবম বা দশম শতাব্দীতে বলরামপুরে যে শুধু জৈন ধর্মের প্রভাব ছিল তা-ই নয়, কথিত রয়েছে বৈষ্ণব সাধক চৈতন্যদেব জঙ্গলমহলে (এই এলাকাকে তখন ঝারিখণ্ড বলা হত) আসেন। তার প্রভাবও পড়েছিল। বলরামপুর অঞ্চলে বৈষ্ণব ধর্ম তার শিকড় মজবুত করে। বেশির ভাগ গ্রামে হরিমন্দিরের অস্তিত্ব এই তথ্যকে সমর্থন করে বলে গবেষকদের মত।

নীল বিদ্রোহের ঢেউ আছড়ে পড়েছিল বলরামপুরেও। বলরামপুর ও সংলগ্ন বেড়াদা, বড়েদা, বুরুডি, লালডি সহ বিভিন্ন গ্রামে নীলের চাষ হত। নেকড়ে গ্রামে এখনও নীলকুঠির ভগ্নাবশেষ রয়েছে। জলপা লায়া নামে এক ভূমিজ সেই বিদ্রোহে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। তাঁর স্মরণে শ্যামনগর গ্রামে একটি স্কুল রয়েছে। চুয়াড় বিদ্রোহ বা কৃষক বিদ্রোহে সে সময় বলরামপুর-সহ গোটা এলাকা উত্তাল হয়ে উঠেছিল। দিলীপবাবুর মতে, ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলা, বিহার, ওড়িশার দেওয়ানি লাভ করার পরে জমি জরিপ করে খাজনা নির্ধারণ করে। কিন্তু কৃষকরা খাজনা দিতে রাজি না হওয়ায় শুরু হয় কৃষক বিদ্রোহ। ১৭৬৭ সাল থেকে বলরামপুর, বরাবাজার, কুইলাপাল, মানবাজার প্রভৃতি জায়গায় শুরু হয়ে যায় কৃষক বিদ্রোহ। সাম্রাজ্যবাদীদের বিরুদ্ধে কৃষকদের এই সংগ্রাম চুয়াড় বিদ্রোহ নামে পরিচিত। জিলপা লায়া, ভরত ভুঁইয়া, গঙ্গানারায়ণ সিং-সহ অনেকে এই সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। সেই সংগ্রামের অন্যতম ক্ষেত্র ছিল এই বলরামপুর।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE