Advertisement
২৩ এপ্রিল ২০২৪
বরাবাজার

নামেই লুকিয়ে জনপদের ইতিহাস

সেই রাজারা নেই। কিন্তু রয়ে গিয়েছে তাঁদের ভগ্নপ্রায় রাজবাড়ির একাংশ। সিংহ দরজার তোরণেও স্থাপত্য কীর্তি এখনও টিকে রয়েছে। রাজবাড়ির মন্দিরের গায়ে সে দিনের শিল্পকলা এখনও অনেককে মুগ্ধ করে। কিন্তু রাঢ়বাংলার সেই বরাভূম রাজ্যের রাজধানী বরাহবাজার থেকে বদলে গিয়েছে বরাবাজারে। নামের মতোই ঝাড়খণ্ড সীমানা লাগোয়া এই জনপদেরও ইতিহাসও হারিয়ে যাচ্ছে। অথচ মল্লরাজধানী বিষ্ণুপুরের মতোই এই শহরকে ঘিরে এখনও রয়ে গিয়েছে ইতিহাসের নানা নিদর্শন।

রাজ পরিবারের মন্দির। ছবিটি তুলেছেন প্রদীপ মাহাতো।

রাজ পরিবারের মন্দির। ছবিটি তুলেছেন প্রদীপ মাহাতো।

সমীর দত্ত
বরাবাজার শেষ আপডেট: ১৩ জানুয়ারি ২০১৫ ০১:৫৫
Share: Save:

সেই রাজারা নেই। কিন্তু রয়ে গিয়েছে তাঁদের ভগ্নপ্রায় রাজবাড়ির একাংশ। সিংহ দরজার তোরণেও স্থাপত্য কীর্তি এখনও টিকে রয়েছে। রাজবাড়ির মন্দিরের গায়ে সে দিনের শিল্পকলা এখনও অনেককে মুগ্ধ করে। কিন্তু রাঢ়বাংলার সেই বরাভূম রাজ্যের রাজধানী বরাহবাজার থেকে বদলে গিয়েছে বরাবাজারে। নামের মতোই ঝাড়খণ্ড সীমানা লাগোয়া এই জনপদেরও ইতিহাসও হারিয়ে যাচ্ছে। অথচ মল্লরাজধানী বিষ্ণুপুরের মতোই এই শহরকে ঘিরে এখনও রয়ে গিয়েছে ইতিহাসের নানা নিদর্শন।

সিংহ দরজার দু’প্রান্তে দু’টি সুবিশাল সিংহ যেন রাজ পরিবারের বীরপুরুষদের প্রতীক! জেলার ইতিহাস নিয়ে যাঁরা চর্চা করেন, তাঁরা জানাচ্ছেন, বিষ্ণুপুরের মল্লরাজারা ৫২ পুরুষ শাসন করেছেন আর পুরুলিয়ার বরাহবাজারের রাজপ্রথা ৪৭ পুরুষ অবধি বজায় ছিল। এই রাজ পরিবারের সূচনাকাল জানাতে গিয়ে রাজবাড়ির বর্তমান প্রবীণ সদস্য কল্যাণীপ্রসাদ সিংহ দেব জানান, ভবিষ্য পুরাণে বরাহবাজার রাজা ও রাজপরিবারের উল্লেখ রয়েছে। এ ছাড়া ‘হান্টার স্ট্যাটিস্টিক্যাল অ্যাকাউন্ট অফ বেঙ্গল জার্নাল’-এর ২৩৫ পাতায় বরাবাজারের রাজ পরিবারের ইতিহাসের কথা উল্লেখ রয়েছে। তাঁর মতে, “৮১ বঙ্গাব্দ থেকে এই রাজ পরিবারের কথা জানা যায়। নাথবরাহকে এই রাজবংশের প্রথম পুরুষ বলে ধরা হয়।”

এই পরিবারের আর এক প্রবীণ সদস্য তথা ইতিহাস সংগ্রাহক রামকৃষ্ণ সিংহ দেবের আক্ষেপ, “এই জনপদের নাম বরাহবাজার। অথচ তা বদলে গিয়েছে বরাবাজারে। সেই নামই মান্যতা পেয়েছে সরকারি নথি, স্কুল-কলেজে। ব্যাপারটি ইতিহাসের পরিপন্থী। বিভিন্ন জায়গায় প্রতিবাদ জানিয়েছি। কিন্তু সঠিক নাম আর ফিরিয়ে আনা যায়নি।” কিন্তু ‘বরাহবাজার’ নামকরণ নিয়ে কৌতূহল অবশ্য কমেনি।

‘বরাহ’ শব্দের ব্যবহার নিয়ে দু’টি ভিন্ন মত চালু রয়েছে। এক পক্ষের মতে, রাজবংশের প্রথম পুরুষ নাথবরাহ শুকরী মায়ের দুধ পান করে বড় হয়েছিলেন। সে কারণেই বরাহ শব্দটি জুড়ে গিয়েছে। অন্যপক্ষের মতে, পঞ্জাবের পাতিয়ালায় এখনও বরাহ পদবি চালু আছে। রাজপরিবারের সঙ্গে পদবি হিসেবেই বরাহ শব্দটি জুড়ে গিয়েছে। রামকৃষ্ণবাবু তাঁর নাম সই করতে গিয়ে রামকৃষ্ণ সিংহ দেব বৈরাটি বলে উল্লেখ করেন। তাঁর দাবি, “মহাভারতের বিরাট রাজারা আমাদের পূর্বপুরুষ ছিলেন। রাজস্থানের বৈরাটি থেকে আমাদের পূর্ব পুরুষেরা এই অঞ্চলে আসেন। সে কারণেই আমাদের বৈরাটি বংশ বলা হয়।”

এই রাজ পরিবারের প্রথম গড় ছিল ঝাড়খণ্ডের পবনপুরে। ইতিহাসবিদদের মতে, নাথবরাহের উত্তরপুরুষেরা পরে বেশ কয়েকবার গড় পরিবর্তন করে ছিলেন। ঝাড়খণ্ডের ইচাগড়ে একটি শিলালিপিতে সংস্কৃত ভাষায় লেখা ‘বরাহ’ শব্দটি অস্পষ্ট হয়ে এলেও এখনও পড়া যায়। ১১৮৪ বঙ্গাব্দে রঘুনাথ নারায়ণ সিংহ দেব দর্পসাহা বরাবাজারে গড় স্থাপন করেন। সেই সময় সামন্তভূমি, মানভূমি ও বরাহভূমি নিয়ে বরাহভূম রাজ্য ছিল। রাজ্যের সীমানা উত্তরে পঞ্চকোট, পূর্বে কুইলাপাল, দক্ষিণে ধলভূম, সিংভূম ও পশ্চিমে পাতকূম অবধি বিস্তৃত ছিল। রাজারা সেই সময় জনহিতকর বহু কাজ করেছিলেন। বিভিন্ন জায়গায় পানীয় জলের জন্য পুকুর খনন ও মন্দির নির্মাণ করেছিলেন। পরে বরাবাজারে স্কুল, ডাকঘর, মুন্সেফ কোর্ট চালু হয়েছিল।

ইতিহাসে বরাবাজারের নাম আরও বেশি করে গেঁথে গিয়েছে গঙ্গানারায়ণী হাঙ্গামার পরে। ১৭৬৫ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি দেওয়ানি লাভের পরে বাংলার আইনগত শাসকের মর্যাদা পেয়ে রাজস্ব আদায়ে জোর দেয়। সেখান থেকে স্থানীয় রাজা ও জমিদারদের সাথে ইংরেজদের বিরোধ শুরু হয়। বরাহবাজারের গঙ্গানারায়ণ সিংহদেব স্থানীয় সামন্ত ও ভূস্বামীদের একত্র করে ইংরেজদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ শুরু করেন। গঙ্গানারায়ণের মৃত্যু হলেও জঙ্গলমহলে ওই বিদ্রোহ ইংরেজদের ঘুম ছুটিয়ে দিয়েছিল। ইতিহাসবিদরা জানাচ্ছেন, স্থানীয় শাসকদের শক্তি খর্ব করতে ১৮৩৩ সালে মানভূম জেলা গঠন করে তার সদর বেছে নেওয়া হয় মানবাজার। স্বাধীনতা লাভের পরেও ভারতবর্ষের বিভিন্ন স্থানে স্বাধীন রাজা ও জমিদার ছিলেন। ১৯৫৬ সালে রাজপ্রথার বিলুপ্তি ঘটে। বরাবাজার রাজ পরিবারের ইতিহাসে শেষ রাজা ছিলেন ৪৭তম বরাহ বনীনাথ। তিনি রাজা হরিশচন্দ্র সিংহ দেব দর্পসাহা নামে পরিচিত ছিলেন।

প্রাক্তন শিক্ষক তথা রাজবাড়ির প্রবীণ সদস্য কল্যাণীপ্রসাদ সিংহ দেব বলেন, ইতিহাস ঘেঁটে আমরা জানতে পেরেছি বরাহবাজার রাজ্যে ৬৮৪টি মৌজা ছিল। আয়তন ছিল ৮ যোজন এলাকা। এক সময় এলাকায় জৈন ধর্মের প্রসার ও প্রচার ঘটেছিল। বরাবাজার থানা এলাকার বিভিন্ন প্রান্তে এই সব নিদর্শন এখনও ছড়িয়ে রয়েছে। সংরক্ষণের অভাবে এই সব পুরা সম্পদ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।” রাজ আমলে পানীয় জল ও সেচের জন্য বিভিন্ন এলাকায় তৈরি করা পুকুরের অনেকগুলি সংস্কারের অভাবে প্রায় বুজে গিয়েছে। কোথাও মজে যাওয়া পুকুরের জমি দখল করে কিছু লোক চাষবাসও শুরু করে দিয়েছেন।

তবে এখনও কিছু প্রথা অটুট রয়ে গিয়েছে। যেমন রাজ পরিবারের ঐতিহ্য মেনে শুধুমাত্র রাজবাড়ির সদস্যদের দাহ করা হয় কুঞ্জবনে। রাজ বৈদ্যদের পরিবারের সৎকার হয় নদীঘাটে, আর সাধারনের জন্য শ্মশান রয়েছে বাল্লার ঘাট। বরাবাজারের নাগরিক কমিটির সম্পাদক বিশ্বতোষ সিংহ মোদক, সদস্য অশোক মুখোপাধ্যায়, পরেশনাথ রাউতদের আক্ষেপ, “সরকারি ভাবে বরাবাজারের ইতিহাস সংরক্ষণের কোনও উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। মন্দির, স্থাপত্য, শিল্প প্রভৃতি কালের নিয়মে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এগুলি সংস্কার ও সংরক্ষণ করা হলে পর্যটকদেরও টেনে আনা যায় এই বরাহবাজারে।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

amar shohor barabazar samir dutta
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE