এই ফুল্লরা মন্দিরের অদূরে দিনমণির রাজধানী গড়ে উঠেছিল বলে কথিত। ছবিটি তুলেছেন সোমনাথ মুস্তাফি।
একের পর এক পাল তোলা নৌকা ভিড়ছে বন্দরে। মোহনায় রান্না চাপিয়ে সারি গান গাইছে মাঝি-মাল্লার দল। নৌকা থেকে পসরা নিয়ে সওদাগর-বণিকেরা পাড়ি জমাচ্ছেন সামলাবাদে। এই ছবি এখন সুদূর ইতিহাস। আর ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে রয়েছে সে দিনের সেই বন্দর ‘লা-ঘাটা’। বণিকদের লাভের মুখ দেখিয়ে সেদিনের সামলাবাদই আজকের লাভপুর।
ইতিহাস বলে, একসময় দীনবন্ধু মিশ্র বাহাদুরের রাজ্যত্ব ছিল শহর-সামলাবাদ। অট্টহাস, ফুলিয়ানগর, সভ্রাজপুর, কর্ম্মাবাজ, শ্রীবাকুল, ডিহি-বাকুল, গণেশপুর প্রভৃতি সংলগ্ন জনপদও ছিল ওই রাজ্যের অর্ন্তভূক্ত। বঙ্গদেশের বর্মণ রাজ সামল বর্মা অনুগ্রহ লাভে রাজ্যত্ব পেয়েছিলেন বলে আনুগত্য বশত দিনমণি মিশ্র তাঁর রাজ্যের সামলাবাদ নামকরণ করেন। পরবর্তীকালে ওসমান নামে মহম্মদ বিন তুঘলকের এক তুরস্কীয় সৈনিকের সঙ্গে যুদ্ধে সামলাবাদের পতন হয়। দীর্ঘদিন পর্যন্ত ‘লড়িয়ে’ পুকুর নামের জলাশয়টি ওই যুদ্ধের স্বাক্ষ্য বহন করেছে। ওই পুকুর থেকেই উদ্ধার হয় একটি বাসুদেব মূর্তি। সেটি প্রতিষ্ঠা এবং নিত্য পুজোর ব্যবস্থা-সহ পুকুরটির সংস্কার করে গোবিন্দসায়র নামকরণ করেন স্থানীয় জমিদার প্রয়াত যাদবলাল বন্দ্যোপাধ্যায়।
রাজা নেই রাজছত্র ভেঙে পড়েছে কবেই! কিন্তু আজও লাভপুরকে ঘিরে রয়েছে রাজ-রাজড়ার এমন নানা কথা ও কাহিনি। সুলতান মামুদের ভারত আক্রমণের সময় একদল বেদানুসারী ব্রাহ্মণ মিথিলা (অন্যমতে কনৌজ) থেকে বিতারিত হয়ে বঙ্গদেশের বর্মণরাজ হরি বর্মার কাছে আশ্রয় লাভ করেন। তাঁদের কয়েকজনকে দেবী ফুল্লরার পুজোর জন্য নিজের জন্মভূমি সিদ্ধলগ্রামে (অধুনা শিতলগ্রাম) নিয়ে আসেন বর্মণ রাজের মহা সন্ধি বিগ্রহিক ভবদেব ভট্ট। যাতায়াত-সহ অন্যান্য অসুবিধার জন্য একসময় ওই পুজারীরা ফুল্লরা মন্দির সংলগ্ন বাকুল, ফুলিয়ানগর, অট্টহাস প্রভৃতি জনপদগুলিতে বসতি স্থাপন করে। পরবর্তীকালে ওই বাহ্মণ বংশেরই দীনমণি মিশ্র বাহাদুর বর্মণ রাজা হন। ফুল্লরা মন্দিরের অদূরে দিনমণির রাজধানী গড়ে ওঠে বলে স্থানীয় বাসিন্দাদের অনুমান।
সেই রাজধানীর ধ্বংসাবশেষ আজ আর নেই! কিন্তু একসময় ওই এলাকার মাটি খুঁড়ে নানা স্থাপত্যের নির্দশন মিলেছে বলে জানান স্থানীয় সংস্কৃতি কর্মী উজ্জ্বল মুখোপাধ্যায়। “রাজত্বের নির্দশন নেই, কিন্তু যে ৭টি জনপদ নিয়ে সামলাবাদ গড়ে উঠেছিল, তাদের অধিকাংশই বিবর্তিত নামে আজও বর্তমান। ফুল্লরামন্দির এলাকাকে অট্টহাস নামেই চেনেন স্থানীয় মানুষ। ভট্টদেবের নিয়ে আসা ওঝা-মিশ্র প্রভৃতি পদবীধারী ওইসব ব্রাহ্মণরাই পুরুষানুক্রমে আজও ফুল্লরা মন্দিরে পুজো করে চলেছেন।” সে দিনের ওসমানের প্রাকার-পরিখা বেষ্টিত গড়ের ধ্বংসাবশেষ আজও রয়েছে ঠাকুরপাড়ায়।
লাভপুরের ইতিহাসের সঙ্গে মিশে রয়েছে ছোট লাইনের ট্রেন, ফুল্লরা মন্দিরের কথাও। যাত্রা থেমে গেলেও মনের ভুলে আজও ছোট লাইনের ট্রেনের বাঁশি শুনতে পান লাভপুরবাসী। যেন চোখের সামনে আজও মন্থর গতির চলন্ত ট্রেন এসে থামে। মাঠ থেকে কেটে আনা ঘাসের বোঝা নিয়ে ট্রেন থেকে নেমে যাছেন কৃষক। সবজির ঝুড়ি মাথায় নামছেন হাটুরের দল। লাভপুরের সঙ্গে পরতে পরতে এমন করেই জড়িয়ে রয়েছে ছোট লাইনের ট্রেন।
১৯১৭ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর ম্যাকলয়েড অ্যান্ড রাসেলস কোম্পানির উদ্যোগে আমোদপুর-কাটোয়া এই রেলপথ স্থাপিত হয়। রেলপথকে ব্রডগেজে রূপান্তরের দাবি দীর্ঘ দিনের। সেই মোতাবেক রূপান্তরের কাজ শুরু হয়েছে। সে কাজের জন্যই ২০১৩ সালের ১৩ জানুয়ারি বন্ধ হয়ে যায় ছোট লাইনের ট্রেনের চলাচল। কিন্তু এখনও ছোট লাইনের ট্রেনের কথা উঠলেই রীতি মতো নস্টালজিক হয়ে ওঠেন এলাকার চিকিৎসক বঙ্কিম মুখোপাধ্যায় ও সুকুমার চন্দ্র। অশিতিপর এই দুই চিকিৎসকই তারাশঙ্করের উপন্যাসে ফটিক এবং বিশু ডাক্তার হিসাবে জায়গা করে নিয়েছিলেন। তারাশঙ্কের লেখাতেও ঘুরে ফিরে এসেছে ওই ট্রেনের কথা। সেই কথা মাথায় রেখে রেল দফতর লাভপুর স্টেশনকে ‘তারাশঙ্কর স্টেশন’ নামকরণ করলে এলাকার মানুষের ভাবাবেগকে মান্যতা দেওয়া হবে, এমনই মনে করেন এলাকার মানুষ।
বঙ্কিম মুখোপাধ্যায় এবং সুকুমার চন্দ্র। —নিজস্ব চিত্র।
ফুল্লরা মন্দির নিয়েও নানা কাহিনি। অসন্তোষও রয়েছে জনমানসে। এখানে দেবীর ওষ্ঠ পড়েছিল বলে কথিত। ভবদেব ভট্টের পূর্বপুরুষ অট্টহাস দেবীকে আবিস্কার করে পুজো প্রচলন করেন বলে এলাকাটি অট্টহাস নামেও পরিচিত। দেবীর মন্দির প্রথম প্রতিষ্ঠা করেন কৃষ্ণানন্দ গিরি। জানা যায়, একসময় মন্দিরের চূড়ায় স্বর্ণকলস শোভা পেত। প্রচলিত রীতি অনুযায়ী অন্যান্য পীঠের মতো এখানেও বিশ্বেশ ভৌরব শিবের মন্দির। বর্তমান মন্দিরটি নির্মাণ করান যাদবলাল বন্দ্যোপাধ্যায়। এছাড়াও মন্দিরের বিভিন্ন নির্মাণ কাজে জড়িয়ে রয়েছে নারায়ণ গিরি, হিরণ্যভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, হরিলাল দত্ত, শ্রীপতি মুখোপাধ্যায়ের নাম। পর্যটন দফতর পক্ষ থেকেও নির্মিত হয়েছে ধ্যানমন্দির এবং সুদৃশ্য তোরণ। এছাড়া রাজ্য বিপণন দফতর তৈরি করেছে তারাশঙ্কর এবং কামদাকিঙ্কর ভবন নামে দুটি অতিথি নিবাসও।
শতাধিক বছরের ফুল্লরা মেলাও ইতিহাসের সাক্ষ্য বহন করে চলেছে। ১০ দিনের ওই মেলা প্রতিবছর মাঘী পূর্ণিমায় শুরু হয়। মেলার স্রষ্টা হিসাবে কুমুদীশ বন্দ্যোপাধ্যায়, পঞ্চানন চট্টোপাধ্যায়, শৈবেশ বন্দ্যোপাধ্যায়, হৃষীকেশ বন্দ্যোপাধ্যায়, যতীন্দ্রমোহন ও বিনোদবিহারী বন্দ্যোপাধ্যায়, হৃষীকেষ দত্ত প্রমুখের নাম জড়িয়ে রয়েছে। ফুল্লরা মন্দির কমিটির অন্যতম সদস্য সুব্রত নারায়ণ দে’র অনুযোগ, “লাভপুর তথা ফুল্লরা মহাপীঠকে কেন্দ্র করে পর্যটন সম্ভাবনা রয়েছে। কিন্তু বিক্ষিপ্ত কিছু নির্মাণ ছাড়া একটি যথার্থ পর্যটন কেন্দ্র হিসাবে তুলে ধরার জন্য ধারাবাহিক কোনও সরকারি পরিকল্পনা নেওয়া হয়নি। তাই ফুল্লরাতলা শুধুমাত্র পিকনিক স্পট এবং বিয়ে দেওয়ার জায়গা হয়ে উঠছে!”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy