Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

শক্তির স্মৃতিচারণা কেঁদুলিতে

মকর সংক্রান্তির মেলায় মাঝে মাঝেই অজয়ের কদমখন্ডীর ঘাটে দেখা যেত লোকটাকে। কখনও দরাজ গলায় গাইছেন, ‘আহা, তোমার সঙ্গে প্রাণের খেলা’। তো কখনও বাউল-আখড়ায় অনুরাগীদের ভিড়ের মধ্যে বসেই নতুন কবিকে লিখে দিচ্ছেন, তাঁর কাব্যের ভূমিকা। তিনি কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়!

জয়দেব মেলায় কবিতা-আড্ডায় কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়। ছবি নীলোত্‌পল ভট্টাচার্যের সৌজন্যে প্রাপ্ত।

জয়দেব মেলায় কবিতা-আড্ডায় কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়। ছবি নীলোত্‌পল ভট্টাচার্যের সৌজন্যে প্রাপ্ত।

অরুণ মুখোপাধ্যায়
সিউড়ি শেষ আপডেট: ০৮ জানুয়ারি ২০১৫ ০০:০৮
Share: Save:

মকর সংক্রান্তির মেলায় মাঝে মাঝেই অজয়ের কদমখন্ডীর ঘাটে দেখা যেত লোকটাকে। কখনও দরাজ গলায় গাইছেন, ‘আহা, তোমার সঙ্গে প্রাণের খেলা’। তো কখনও বাউল-আখড়ায় অনুরাগীদের ভিড়ের মধ্যে বসেই নতুন কবিকে লিখে দিচ্ছেন, তাঁর কাব্যের ভূমিকা। তিনি কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়!

কেঁদুলি মেলায় কবিকে দেখার এমন সব টুকরো স্মৃতি নিয়েই এবার জয়দেব অঞ্চল সংস্কৃতি পরিষদ মেলার দ্বিতীয় দিন ‘স্মৃতি কথায় কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়’ শীর্ষক একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে। যাঁরা কবির সঙ্গে থাকতেন, তাঁদের আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। স্মৃতিকথা বলার সঙ্গে সঙ্গে কবির কিছু নির্বাচিত কবিতাও পাঠ করা হবে। শক্তির নানা টুকরো স্মৃতিতে এখনও আচ্ছন্ন বীরভূমের কবি, লিটিল ম্যাগাজিন কর্মী ও স্থানীয় মানুষেরা। সেইসব স্মৃতিকথা শুনতে জয়দেব অঞ্চল সংস্কৃতি পরিষদ এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে। উদ্যোক্তাদের পক্ষে আনারুল হক ও সুভাষ কবিরাজ জানিয়েছেন, ১৬ জানুয়ারি ভক্তিভবনে এই সভা হবে। শক্তির কবিতা পড়বেন জেলার কবিরা।

অনুষ্ঠানের কথা শুনে আপ্লুত কবি দীপ মুখোপাধ্যায়। তিনি বলেন, “শক্তিদাকে নিয়ে অনুষ্ঠান, সে তো দারুন ব্যাপার। শক্তিদাকে নিয়ে কত স্মৃতি যে রয়েছে!” দীপবাবুর স্মৃতি থেকে জানান, সাতের দশকের শেষের দিক বা আটের দশকের গোড়ার দিকে শকুন্তলা সাহিত্য পত্রিকার সম্পাদক অমিত গুপ্ত, চিত্রবাণী-র দীপক মজুমদার, মহীনের ঘোড়াগুলির গৌতম চট্টোপাধ্যায়, কবি অরুণ চক্রবর্তী-সহ জয়দেবে মিলিত হতাম। থাকতেন শক্তিদাও। বীরভূমের তরুণ কবিরা মিলে আমরা একসঙ্গে জয়দেবের মেলায় এক গৃহস্থের খরের বাড়ির রান্নাঘর ভাড়া নিয়ে কয়েকদিন থাকতাম। মেঝেতে খড় বিছানো, তার উপরে শতরঞ্জি পাতা থাকত। তিনি বলেন, “সেখানে মাঝরাত পর্যন্ত কবিতা পাঠ ও গান চলত। শক্তিদা অসাধারন রবীন্দ্র সঙ্গীত গাইতেন। একবার তাঁর গলায় ‘চিরসখা, ছেড়ো না মোরে’ শুনে দীপকদা বলছিলেন, ‘শক্তি যদি গানটাই গাইত, বহু শিল্পী মুখ থুবড়ে পড়ত!’”

কেঁদুলি মেলায় কবি শক্তির সঙ্গী ছিলেন বীরভূমের কবি-শিল্পী নীলোত্‌পল ভট্টাচার্যও। তিনি বলেন, “শক্তিদা যখন প্রথম দিকে জয়দেব মেলায় আসতেন, তখন জেলার পুলিশ সুপার ছিলেন কবি আয়ান রসিদ খান। তিনি বন্ধু, শক্তিদার সঙ্গে আড্ডা দিতে এসে মীরজা গালিবের গজল গাইতেন। একবার শক্তিদা বাড়িতে এবং কর্মক্ষেত্রে কাউকে কিছু না জানিয়ে মেলায় এসেছিলেন। সেই নিয়ে তুমুল খোঁজা খুঁজি শুরু হয়ে যায়। শেষে পুলিশ শক্তিদার হদিশ পায়। ইলামবাজার থানা থেকে শক্তিদার বাড়িতে সব কিছু জানায় সে বার।”

শক্তির স্মৃতি এখনও ভিড় করে আসে জয়দেব মেলায় গেলে বীরভূমের আরেক বর্ষিয়ান কবি তথা লেখক আদিত্য মুখোপাধ্যায়ের। তিনি বলেন, “আমার সম্পাদিত বীরভূমের বিশ শতকের কবিতার ভূমিকা লিখে দিয়েছিলেন শক্তিদা জয়দেবের এক বাউল আখরায় বসে।” তেমন স্মৃতির কথা শোনালেন কলকাতার বেহালার বাড়ি থেকে আর্ন্তজাতিক বাউল পবন দাসও। টেলিফোনে পবন বলেন, “শক্তিদা আমার গান খুবই পছন্দ করতেন। আমার গলায় তাঁর প্রিয় গান ছিল, ‘তুই আমারে পাগল করলি রে’। যে বার শক্তিদা সস্ত্রীক প্যারিসে গিয়েছিলেন, আমার বাড়িতেই তিন দিন ছিলেন।”

কেঁদুলিতে কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের নানা স্মৃতি জড়িয়ে যে বাড়িটিকে ঘিরে, সে বাড়ির মালিক তাপস রায়। শক্তি কেঁদুলি মেলায় গিয়ে থাকতেন এই বাড়িতেই। কবিকে নিয়ে এমন একটি সভার উদ্যোগে খুশি তিনি। তাপসবাবু বলেন, “সাহিত্যের আখড়া বানাবেন বলে শক্তিবাবুরা আমাদের কাছ থেকে চার শতক জায়গা কিনেছিলেন ত্রিশ হাজার টাকা দিয়ে। সেই জায়গাটি ফাঁকা পড়ে রয়েছে!”

জয়দেব মেলা থেকে দুবরাজপুরের ফকির ডাঙায় দরবেশ মেলাতেও কখনও সখনও যেতেন শক্তি। আর যেখানেই যেতেন, গানে-কবিতায়-আড্ডায় জমিয়ে দিতেন। এই সব মেলাতে গিয়ে আশ্চর্য সব পদ্য পংক্তিও লিখেছেন তিনি। একবার এমন দরবেশ মেলাতে গিয়েই সিগারেটের প্যাকেট ছিঁড়ে, তার উপর চটজলদি লিখেছিলেন, ‘ভুলে যাওয়া রগড় ছিল দরবেশেরই এই মেলা’!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE