Advertisement
১৭ এপ্রিল ২০২৪

নাড়ু ছুড়ে বন্দনা লাভপুরের গ্রামে

এ বারও অন্যথা হয়নি। প্রতিবছর কালীপুজো উপলক্ষে পরিত্যক্ত সেই গ্রাম দু’দিনের জন্য প্রাণ ফিরে পায়। ছেলেমেয়ের কলকাকলি, বড়দের হাঁকডাকে জমজমাট হয়ে উঠে এলাকা। শুক্রবার রাতে সেই গ্রামেই কালীপুজোর আয়োজনে মেতে উঠেছেন অন্যত্র উঠে যাওয়া গ্রামবাসী।

বন্যার কবল থেকে গ্রাম বাঁচাতে শুরু হয় এই পুজো। শনিবার। ছবি:কল্যাণ আচার্য

বন্যার কবল থেকে গ্রাম বাঁচাতে শুরু হয় এই পুজো। শনিবার। ছবি:কল্যাণ আচার্য

অর্ঘ্য ঘোষ
লাভপুর শেষ আপডেট: ১৮ মার্চ ২০১৮ ০২:৩২
Share: Save:

গ্রাম আর নেই। গ্রামরক্ষার উদ্দেশে প্রচলিত কালীপুজো থেকে গিয়েছে। আর অভিমান প্রকাশের অনুসঙ্গ হিসেবে রয়েছে মা কালীর জিভ ভাঙার উদ্দেশে মুড়ির নাড়ু ছোঁড়ার সাবেক রীতি।

প্রচলিত রয়েছে, এক সময় কুঁয়ে নদীর তীরে পানপাড়া বলে একটি গ্রাম ছিল। লাভপুর থানা এলাকার ওই গ্রামে বাস করত শতাধিক পরিবার। ফি বছরের বন্যায় ভিটে-মাটি খুইয়ে অবস্থাপন্ন পরিবারগুলি অতিষ্ট হয়ে ভিটেমাটি ছেড়ে অন্যত্র উঠে যায়। কিন্তু, দুঃস্থ পরিবারগুলির সেই সুযোগ ছিল না। তারা গ্রামেই কার্যত মাটি কামড়ে পড়ে থাকে। আর বন্যার প্রকোপ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য মা-কালীর পুজোর প্রচলন করেন। আর্থিক দুরবস্থার কারণে নৈবেদ্য হিসেবে ফলমূল কিংবা মিষ্টি দেওয়ার সামর্থ্য ছিল না তাদের। তাই নিজেদের গাছের কলা, পেঁপের পাশাপাশি মিষ্টি হিসেবে গুড়-মুড়ির নাড়ুর নৈবেদ্য দেন তাঁরা। তারপরেও বন্যা থামেনি।

এই সময় একবার পুজো শেষে বন্যায় সর্বশান্ত গ্রামবাসী মায়ের কাছে অনুযোগ করেন। অভিমানে জানান, মা পুজো নিয়েও ভক্তের দুর্দশার কথা ভগবান ভুলে গেল কী করে? তার পরেই অভিমানে নৈবেদ্যের মুড়ির নাড়ু মায়ের জিভ লক্ষ্য করে ছুড়তে থাকেন তাঁরা। ইতিমধ্যে কুঁয়ে নদীতে বহু জল বয়ে গিয়েছে। ধূলিসাৎ হয়ে গিয়েছে নদী তীরবর্তী বহু গ্রাম। তবুও বন্যা প্রতিরোধ হয়নি। ১৯৬৩ সালের বন্যায় পানপাড়া গ্রামও ধূলিসাৎ হয়ে যায়। গ্রাম ছেড়ে বাসিন্দারা একে একে মহেশগ্রাম, কেমপুর, হরানন্দপুর, বামুনডিহি প্রভৃতি গ্রামে ছড়িয়ে পড়েন। সেই গ্রাম আজও জনমানব শূন্য প্রান্তর হয়ে পড়ে রয়েছে। কিন্তু, গ্রামরক্ষার উদ্দেশে প্রচলিত সেই পুজো আজও চালু রয়েছে। টিকে রয়েছে মুড়ির-নাড়ু ছুড়ে মায়ের জিভ ভাঙার ক্ষোভ প্রকাশের রীতিও।

এ বারও অন্যথা হয়নি। প্রতিবছর কালীপুজো উপলক্ষে পরিত্যক্ত সেই গ্রাম দু’দিনের জন্য প্রাণ ফিরে পায়। ছেলেমেয়ের কলকাকলি, বড়দের হাঁকডাকে জমজমাট হয়ে উঠে এলাকা। শুক্রবার রাতে সেই গ্রামেই কালীপুজোর আয়োজনে মেতে উঠেছেন অন্যত্র উঠে যাওয়া গ্রামবাসী। পুজো চলে শনিবার দুপুর পর্যন্ত। পুজোর পরেই শুরু হয়ে যায় নাড়ু ছোড়ার প্রতিযোগিতা। গুড়-মুড়ির নাড়ু নিয়ে দেখা গেল গৃহবধূ চুমকি হাজরা, সীমা মেটে, বনানী মেটেদের। তাঁরা জানান, বহু দিন আগেই পূর্বপুরুষেরা গ্রাম ছেড়ে অন্যত্র উঠে যান। কিন্তু, পুরুষানুক্রমে এই দিনটিতে মুড়ির নাড়ু তৈরি করে নিয়ে আসেন।

অন্যতম সেবাইত সরমা হাজরা বলেন, ‘‘হাজারখানেক মানুষ মুড়ির নাড়ু ছুড়তে আসেন। কিন্তু, আজ পর্যন্ত কেউ জিভ ভাঙতে পারেননি।’’ প্রচলিত এই রীতিতে খুশি কচিকাঁচারা।
চতুর্থ শ্রেণির ছাত্রী রিয়া হাজরা, সোনালি হাজরারা বলে, ‘‘চার দিকে এত ভাঙা নাড়ু ছড়িয়ে পড়ে যে, কুড়িয়ে খেতে খেতে আমাদের পেট ভরে যায়।’’

কেন এই রীতি? মহাদেব হাজরা, মেঘনাথ হাজরারা বলেন, ‘‘বাপ-ঠাকুর্দার মুখে শুনেছি, বন্যা প্রতিরোধে পুজোর প্রচলন করা হয়েছিল। কিন্তু, সে কথা ভুলে গিয়ে মা জিভ বের করেছিলেন। সেই অভিমানেই জিঙ ভাঙার চেষ্টা।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Labpur kali puja
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE