Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

বাড়ির পাশেই অস্ত্র কারখানা, তাজ্জব বাসিন্দারা

বড় পাঁচিল দিয়ে ঘেরা টিনের ছাউনির ভাড়াবাড়ির ভিতর থেকে সারা দিন ঘটাং ঘটাং শব্দ শোনা যেত। বাসিন্দাদের মনে হয়েছিল, আর পাঁচটা কারখানার মতো সেখানে বিভিন্ন মেশিনের যন্ত্রাংশ তৈরি করা হয়। কিন্তু রঘুনাথপুরের ব্লকডাঙার সেই ‘হামিদ ওয়েল্ডিং শপ’-ই যে আস্ত একটা অস্ত্র তৈরির কারখানা, শুক্রবার পুলিশি অভিযানের আগে পড়শিরা তা জানতে পারেননি।

এই বাড়িতেই চলত কারখানা।

এই বাড়িতেই চলত কারখানা।

শুভ্রপ্রকাশ মণ্ডল
রঘুনাথপুর শেষ আপডেট: ২৩ মার্চ ২০১৫ ০০:১১
Share: Save:

বড় পাঁচিল দিয়ে ঘেরা টিনের ছাউনির ভাড়াবাড়ির ভিতর থেকে সারা দিন ঘটাং ঘটাং শব্দ শোনা যেত। বাসিন্দাদের মনে হয়েছিল, আর পাঁচটা কারখানার মতো সেখানে বিভিন্ন মেশিনের যন্ত্রাংশ তৈরি করা হয়।

কিন্তু রঘুনাথপুরের ব্লকডাঙার সেই ‘হামিদ ওয়েল্ডিং শপ’-ই যে আস্ত একটা অস্ত্র তৈরির কারখানা, শুক্রবার পুলিশি অভিযানের আগে পড়শিরা তা জানতে পারেননি। গত প্রায় আড়াই বছর ধরে শহরের জনবসতিপূর্ণ এলাকায় ওই কারখানা চললেও ঘুণাক্ষরেও তা জানতে পারেনি রঘুনাথপুর থানাও। শুক্রবার দুপুরে পুলিশ সুপার রূপেশ কুমার অভিযান চালিয়ে ওই কারখানা থেকে পিস্তলের প্রচুর যন্ত্রাংশ উদ্ধারের পরেই ঘটনাটি প্রকাশ্যে আসে। ধরা পড়ে ওই কারখানায় কাজ করা ছয় দুষ্কৃতী। সব জানার পরে শহরবাসী ভয় পেয়েছেন তো বটেই, রীতিমতো অবাকও। সেই সঙ্গে রঘুনাথপুর থানার পুলিশের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।

ইতিমধ্যেই ফাঁদ পেতে আরও একজনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। পুলিশ সুপার রবিবার বলেন, “পিস্তল তৈরির মূল পাণ্ডা ইসরার আহমেদকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তার বাড়ি ঝাড়খণ্ডের ধানবাদ জেলার ঝরিয়াতে।” পুলিশের দাবি, ইসরারের বিরুদ্ধে ঝাড়খণ্ডে অপরাধমূলক বেশ কিছু কাজে জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে। আগে সে একবার প্রায় একবছর জেলও খেটেছে। কারখানা থেকে ধৃত ছ’জনের মাধ্যমে তাকে ফোন করে রঘুনাথপুরে ডেকে এনে শনিবার রাতে পুলিশ পাকড়াও করে। রবিবার তাকে রঘুনাথপুর আদালতে তোলা হলে ১৩ দিনের পুলিশ হেফাজত হয়। ধৃতদের বিরুদ্ধে অস্ত্র আইনে মামলা রুজু করেছে পুলিশ। পুলিশ সুপার বলেন, “প্রাথমিক ভাবে জানা গিয়েছে, রঘুনাথপুরে পিস্তলের খোল ও যন্ত্রাংশ তৈরি করে এরা বিহার ও ঝাড়খণ্ডে নিয়ে যেত। তারপর কোথায় পুরো পিস্তল তৈরি করা হত, সেই পিস্তল কোথায় পাচার করা হত তা জানতে জেরা করা হচ্ছে।”

ধৃত দুষ্কৃতী দলের পাণ্ডা
ইসরার আহমেদ।

পুলিশের একটি সূত্রে জানা যাচ্ছে, পুলিশ সুপারের অভিযানের বিষয়ে আগাম কিছুই জানত না স্থানীয় পুলিশ। অভিযানে উদ্ধার হয় প্রচুর পরিমাণে নাইম এমএম পিস্তলের খোল-সহ আগ্নেয়াস্ত্রের যন্ত্রাংশ। ওই বাড়ি থেকে ধৃতদের শনিবার রঘুনাথপুর আদালতে তোলা হয়েছিল। ধৃতদের মধ্যে মহম্মদ আমির, মহম্মদ চাঁদ, মহম্মদ সিকান্দারের জেলহাজত হয়েছে। বাকি তিনজন অরুণকুমার বর্মা, রূপেশ কুমার ও মহম্মদ চাঁদের ১৪ দিনের পুলিশ হেফাজত হয়েছে। ধৃতদের জেরা করেই চক্রটির মূল পাণ্ডা ইসরার আহমেদের হদিস পেয়েছে পুলিশ।

২০১১ সালের শেষদিকে ব্লকডাঙা এলাকায় কবরস্থানের অদূরে হারাধান গড়াইয়ের এই বাড়িটি মাসে ১০০০ টাকা ভাড়ায় নিয়েছিল হামিদ আনসারি নামের এক ব্যক্তি। তার বাড়ি ঝাড়খণ্ডের ঝরিয়ায়। তার সন্ধানে শনিবার রাতে রঘুনাথপুর থানার পুলিশ ঝরিয়ায় অভিযানে গেলেও সেখানে তাকে পাওয়া যায়নি। তদন্তে পুলিশ জানতে পেরেছে এই হামিদ ধৃত ইসরার আহমেদের সহকারী। হামিদের নামেই ছিল কারখানাটি।

হারাধনবাবুর দাবি, ভাড়া নেওয়ার সময় হামিদ জানিয়েছিল সে এই বাড়িতে ওয়েল্ডিং কারখানা করবে। রঘুনাথপুর পুরসভার কাছ থেকে ট্রেড লাইসেন্সও নিয়েছিল সে। যদিও পরে আর লাইসেন্সের পুর্ননবীকরণ করায়নি। ওয়েল্ডিং কারখানা চালানোর জন্য বিদ্যুত্‌ দফতরের কাছ পৃথক ভাবে থেকে ৪৪০ ভোল্টের বিদ্যুত সংযোগও তারা নিয়েছিল। বিকল্প হিসেবে ছিল জেনারেটরও।

জেলা পুলিশের এক পদস্থ কর্তার জানান, ধৃতেরা পুলিশকে জানিয়েছে, ভাড়া নিলেও বিদ্যুত সংযোগ পেতে দেরি হওয়ায় ২০১২ সালের শেষ দিক কারখানা চালু করে তারা। কারখানার বাইরে বোর্ডে বিভিন্ন মেশিনের যন্ত্রাংশ তৈরি করা হয় বলে লেখা থাকলেও আদতে তারা পিস্তলের যন্ত্রাংশ তৈরি করত।

আশপাশের অন্য ভাড়াটেরদের মধ্যে বাপি সরকার, অর্জুন গড়াই, বন্দনা গড়াই বলেন, “কারখানার এলাকজন আমাদের সঙ্গে মেলামেশা করত না। দিনভর কারখানায় কাজ চলত। কখনও রাতেও কাজ হত।” অন্য বাসিন্দারা জানান, মাঝে মধ্যে একটা গাড়িতে দু’জন আসত। তার মধ্যে একজন কারখানায় ঢুকত। তাঁরা জানান, আর পাঁচটা সাধারণ ওয়েল্ডিং কারাখানার মতোই এখানেও লোহার কাজ হচ্ছে বলে তাঁরা ভেবেছিলেন। কিন্তু তাঁদের বাড়ির কাছেই যে আস্ত পিস্তল তৈরির কারখানা চলছে, সে বিষয়ে তাঁদের বিন্দুমাত্র সন্দেহ হয়নি।

বাড়ির মালিক হারাধনবাবুরও দাবি, “সময় মতো ভাড়া পেতাম। কিন্তু সেখানে যে পিস্তল তৈরির কাজ চলছে জানতে পারিনি। একবার কারখানায় গিয়েছিলাম। তখন অবশ্য পিস্তল দেখতে পাইনি।”

—নিজস্ব চিত্র।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE