Advertisement
২৩ এপ্রিল ২০২৪

আশ্বাস সার, পাঁচামি আঁধারেই

রোজগারের পথ দুর্গম। ঘরে-বাইরে দূষণ। ন্যূনতম স্বাস্থ্য পরিষেবার অভাব। তেমন ভাবে পৌঁছয়নি শিক্ষার আলোও। এই হাজারো সমস্যার ভিড়েই হারিয়ে যেতে বসেছে রাজ্যের অর্থনৈতিক মানচিত্রে বড় শিল্পাঞ্চল বলে পরিচিত মহম্মদবাজারের পাঁচামির সাধারণ মানুষের জীবনযাপন। আদিবাসী সম্প্রদায় অধ্যুষিত এই এলাকায় ঘুরলে সংখ্যাগরিষ্ঠ বাসিন্দাদের কাছ থেকে ঘুরেফিরে অন্তত এমনটাই অভিযোগ উঠে আসে বারবার। প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে শাসক বদলালেও মানুষের ক্ষোভ-বিক্ষোভের সেই চিত্রটা বদলায়নি এতটুকুও!

হাবড়াপাহাড়ির কাছে বেহাল রাস্তার ছবিটি তুলেছেন অনির্বাণ সেন।

হাবড়াপাহাড়ির কাছে বেহাল রাস্তার ছবিটি তুলেছেন অনির্বাণ সেন।

ভাস্করজ্যোতি মজুমদার
মহম্মদবাজার শেষ আপডেট: ২৮ মে ২০১৫ ০০:৩৭
Share: Save:

রোজগারের পথ দুর্গম। ঘরে-বাইরে দূষণ। ন্যূনতম স্বাস্থ্য পরিষেবার অভাব। তেমন ভাবে পৌঁছয়নি শিক্ষার আলোও। এই হাজারো সমস্যার ভিড়েই হারিয়ে যেতে বসেছে রাজ্যের অর্থনৈতিক মানচিত্রে বড় শিল্পাঞ্চল বলে পরিচিত মহম্মদবাজারের পাঁচামির সাধারণ মানুষের জীবনযাপন। আদিবাসী সম্প্রদায় অধ্যুষিত এই এলাকায় ঘুরলে সংখ্যাগরিষ্ঠ বাসিন্দাদের কাছ থেকে ঘুরেফিরে অন্তত এমনটাই অভিযোগ উঠে আসে বারবার। প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে শাসক বদলালেও মানুষের ক্ষোভ-বিক্ষোভের সেই চিত্রটা বদলায়নি এতটুকুও!

ঘটনা হল, পাঁচামি ও তালবাঁধ মিলিয়ে এলাকায় ৪০টি খাদান এবং ৪৫০টি মতো পাথরকল (ক্রাশার) আছে। স্থানীয় বাসিন্দাদের দাবি, খাদান ও পাথরকল চালানোর ক্ষেত্রে সরকারি নিয়ম নীতির ধার ধারে না মালিকেরা। আর তা নিয়ে নজরদারি নেই সংশ্লিষ্ট সরকারি দফতরগুলিরও। সেটাই সমস্যার মূলে বলে মত বাসিন্দাদের। তাঁদের দাবি, পাথর শিল্পাঞ্চলে দূষণের কারনে এলাকার বহু মানুষই যক্ষা, সিলিকোসিসের মতো রোগের শিকার। তার পরেও পানীয় জল থেকে স্বাস্থ্য, শিক্ষা, রাস্তা— প্রয়োজনীয় সমস্ত রকম মৌলিক পরিষেবা থেকেই বঞ্চিত এখানকার মানুষ। পাঁচামির ফিলিপস্ মুর্মু, সাগরবাঁধির সুমিত্র মুর্মু, মথুরাপাহাড়ির কালীচরণ টুডু, পাথরপাড়ার গনে টুডুরা বলছেন, ‘‘চারি দিকে শুধু ধুলো আর ধুলো। ধুলোয় এলাকায় বাস করা দায়। ঘরের দরজা-জানালা পর্যন্ত খোলা যায় না।’’ ধুলোর কারণে বাসিন্দাদের মধ্যে যক্ষা-সহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হওয়ার অভিযোগ করছেন স্থানীয় ভাঁড়কাটা পঞ্চায়েতের সাগরবাঁধি সংসদের সদস্যা মানি হাঁসদা এবং পাঁচামি সংসদের সদস্য কার্তিক টুডুও। তাঁরা বলেন, ‘‘নিয়ম মেনে খাদান বা পাথরকল চালালে এত অসুবিধে হতো না। অন্তত যদি এলাকায় জলটাও ঠিকঠিক ভাবে ছড়ানোর কাজ করত, তা হলেও ধুলো অনেকটা কম উড়ত।’’

এ নিয়ে প্রশাসনের নানা স্তরে অভিযোগ করেও কোনও লাভ হয় না বলে আক্ষেপ বীরভূম আদিবাসী গাঁওতা সংগঠনের নেত্রী সাগরবাঁধি গ্রামের বুধনি টুডুর। তাঁর কথায়, ‘‘মানছি, খাদান ও পাথরকলের জন্য এলাকার লোক জন বারো মাস কাজ পাচ্ছেন। কিন্তু, এই কাজ পেয়ে কী লাভ? লোক জন যদি অসুস্থই হয়ে পড়েন! শুধু দূষণই নয়, এলাকার গরিব আদিবাসীদের জমিও নানা ভাবে হাতিয়ে নিচ্ছে এক শ্রেণির পাথর ব্যবসায়ী।’’ প্রশাসন কবে আদিবাসীদের পাশে দাঁড়াবে, সেই উত্তরই খুঁজে চলেছেন বুধনিরা। তবে, ‘পাঁচামি মাইন্স ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনে’র সভাপতি নাজির হোসেন মল্লিক অভিযোগ মানতে নারাজ। তাঁর বক্তব্য, ‘‘জল না দেওয়া বা নিয়ম নীতি না মেনে চলার অভিযোগ ঠিক নয়। সমস্ত নিয়ম মেনেই খাদান বা পাথরকল চালানো হয়। রাস্তায় নিয়মিত জলও দেওয়া হয়।’’ অবশ্য যদি কোনও খাদান বা পাথরকল মালিক নিয়ম-নীতি না মানেন, তাঁদের সংগঠনের কাছে এ নিয়ে নির্দিষ্ট অভিযোগ জমা পড়লে ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দিচ্ছেন নাজির হোসেন মল্লিক।

তবে, পাঁচামি শিল্পাঞ্চলের যন্ত্রণার শেষ এখানেই নয়। এলাকার বেহাল রাস্তা কার্যত আধুনিক সভ্যতার ভাল-মন্দের থেকে এখানকার বাসিন্দাদের দূরে রেখেছে। মোরগ্রাম-রানিগঞ্জ ৬০ নম্বর জাতীয় সড়কের মহম্মদবাজারের রায়পুর ও দেউচা থেকে দু’টি রাস্তা ঢোলকাটা পর্যন্ত গিয়েছে। একটি রায়পুর থেকে হরিণসিঙা হয়ে আর একটি দেউচা সেতুর উত্তর দিক থেকে ঢোলকাটার দিকে চলে গিয়েছে। প্রথমটির দৈর্ঘ্য ৯ কিলোমিটার, দ্বিতীয় রাস্তাটি ১২ কিলোমিটার মতো। মূলত এই দুই রাস্তার উপরেই নির্ভরশীল এলাকার হাজার হাজার মানুষ। দু’টি রাস্তাই খানাখন্দে ভরা। সারা রাস্তাজুড়ে পাথর উঠে আছে। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দিনভর সাধারণ মানুষ থেকে পাথর বোঝাই হাজার বারোশো গাড়ি ওই পথ দিয়েই চলাচল করছে।

শালডাঙার বাসিন্দা তথা মল্লারপুরের টুরকু হাঁসদা কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী পূর্ণিমা টুডু, সোনালি মারান্ডি, মথুরাপাহাড়ির বাবুধন কিস্কু, ঢোলকাটার বাসিন্দা তথা সাঁইথিয়া অভেদানন্দ কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের বাংলা সাম্মানিকের ছাত্র কালিদাস সোরেন, বিএ তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী অনিতা সোরেনদের প্রতি দিনই এই দুর্গম রাস্তা পেরিয়েই নিজের নিজের কলেজে যেতে হয়। তাঁদের কথায়, ‘‘এখানকার রাস্তাঘাট দেখলে কেউ বলবে না আমাদের এলাকা পাথর শিল্পাঞ্চল বলে খ্যাত। অথচ এই জমির পাথরেই সারা রাজ্যজুড়ে, এমনকী বাইরের রাজ্যেও কত কত ঝাঁ চকচকে রাস্তা তৈরি হচ্ছে। আর আমাদের এই রাস্তায় গাড়ি দূর পায়ে হাঁচাও দায়! তার পরেও ওই রাস্তার উপর দিয়েই আমাদের নানা প্রয়োজনে সাইকেলে বা পায়ে হেঁটে প্রতি দিন রায়পুর, দেউচা-সহ জেলার বিভিন্ন প্রান্তে যাতায়াত করতে হয়।’’

এ দিকে, এমনিতেই পাঁচামি এলাকার জলস্তর ভাল না। গরম পড়তে না পড়তেই টিউবওয়েলে জল ওঠে না। আশপাশের এলাকায় চাষের জন্য প্রচুর গভীর নলকূপ বসায়, তা আরও প্রকট রূপ নেয়। বহু দাবিদাওয়ার পরে শেষমেশ ২০০২-’০৩ অর্থবর্ষে এলাকায় একটি জলপ্রকল্পের কথা ঘোষণা করেছিল তৎকালীন বাম সরকার। ওই বছরই ভাঁড়কাটা পঞ্চায়েতের হাটগাছায় ৩৮৫ কোটি টাকার ‘হাটগাছা জল সরবরাহ প্রকল্পে’র উদ্বোধনও হয়ে যায়। সরকারের আশ্বাস ছিল, এলাকার ২৫টি গ্রামের ৩৪টি পাড়ায় জল পৌঁছে দেওয়া হবে। ২০০৫ সালে বিধানসভা ভোটের ঠিক আগে জল দেওয়াও শুরু হয়। তার পরে? তালবাঁধের বাসিন্দা, অবসরপ্রাপ্ত জওয়ান বাবুলাল টুডুর কথায়, ‘‘জল প্রকল্প শুরু হওয়ার কিছু দিন পর থেকেই মুখ থুবড়ে পড়ে। কোনও গ্রাম জল পেত, কোনও গ্রাম পেত না। ওই প্রকল্প নিয়ে প্রথম থেকেই আমাদের মনে সন্দেহ ছিল। কারণ বাস্তব পরিস্থিতি মেনে ও বিজ্ঞানসম্মত ভাবে ওই জলপ্রকল্প তৈরি করা হয়নি। ফলে এলাকার জল-সঙ্কটের কোনও সুরাহা হয়নি।’’ বাসিন্দাদের দাবি, চিত্রটা একই রয়েছে তৃণমূল আমলেও।

পাঁচামি পিছিয়ে রয়েছে শিক্ষাতেও। ভাঁড়কাটা পঞ্চায়েতের গিরিজোড় গ্রামে একটি হাইস্কুল আছে। যার উপর গিরিজোড়-সহ আশেপাশের প্রায় ২০টি গ্রাম নির্ভরশীল। গ্রামগুলির অধিকাংশই স্কুল থেকে চার-পাঁচ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। দূরত্ব এবং অভাবের কারণে অনেকেই সিক্স, সেভেন কিংবা এইট পর্যন্ত পড়ে আর স্কুলমুখো হয় না। অগত্যা মা-বাবা, দাদা-দিদিদের হাত ধরে খাদান বা ক্রাশারের কাজে হাত লাগায়। অনেকেই আবার উচ্চ শিক্ষার স্বপ্ন দেখে পড়াশোনা চালিয়ে যায়। মাধ্যমিক পাশও করে। কিন্তু, তারপর? বাসিন্দারা বলছেন, ‘‘অচিরেই ওদের স্বপ্ন ধ্বংস হয়। এলাকায় কাছাকাছি উচ্চ মাধ্যমিক স্কুল বলতে কাপাসডাঙা ও দেউচা। ওই সব গ্রাম থেকে দু’টিই দূরত্ব কম করে ১০-১৫ কিলোমিটার। এতটা পথ হয় পায়ে হেঁটে বা সাইকেলে গিয়ে অনেকের পক্ষেই আর পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হয় না।’’ শালডাঙার অনিতা মুর্মু, মেরিলা সোরেন, ঢোলকাটার ধন মুর্মু, হাবড়াপাহাড়ির বেণী টুডু... স্কুলছুটদের তালিকা ক্রমশ বাড়তে থাকে।

দুই গাঁওতা নেতা রবিন সোরেন এবং সুনীল সোরেন ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, ‘‘দূষণের কারণে এলাকার মানুষ অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। যক্ষা রোগীর সংখ্যাও দিনদিন বাড়ছে। এলাকায় স্বাস্থ্যপরিষেবা নেই বললেই চলে। সোঁতপাহাড়ি ও জগৎপুরে দু’টি উপ-স্বাস্থ্যকেন্দ্র আছে। কিন্তু, সেখানে চিকিৎসকেরা ঠিকমতো আসেন না। এলাকার বাসিন্দারা আশাকর্মীর উপর নির্ভরশীল। সামান্য জ্বর হলেও মানুষকে সিউড়ি সদর হাসপাতালে ছুটতে হয়। পাঁচামির দুর্দশার অন্ত যেন নেই।’’ বারবার প্রশাসনের কাছে সমস্যার কথা জানিয়েও কোনও ফল পাননি বলেই তাঁদের দাবি। তাই এলাকার সামগ্রিক উন্নয়নের ব্যাপারে এ বার সংগঠন উচ্চ আদালতের দ্বারস্থই হবে বলে রবিনরা জানিয়েছেন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE