কালবৈশাখী এসে মাঝে মধ্যেই গাছপালা দুলিয়ে বৃষ্টি ঢেলে স্বস্তি ফিরিয়ে দিচ্ছিল। তাতে বৈশাখ ততটা উত্তপ্ত হয়ে উঠতে পারেনি। কিন্তু গ্রীষ্মের গোড়ায় ঝড়-বৃষ্টি ‘বেপাত্তা’ হওয়ায় চড়চড়িয়ে উঠছে পারদ। সকাল থেকেই আকাশের দিকে মেঘের খোঁজে তাকিয়ে রয়েছেন তামাম বাঁকুড়াবাসী। কিন্তু মেঘের দেখা নেই। উল্টে রোদের প্রবল তেজে চোখ ধাঁধিয়ে যাচ্ছে।
গরমের দাপটে না বাইরে, না ঘরে কোথাও স্বস্তি নেই। বাইরে গাছ-পালায় হাওয়ার নাচন নেই বললেই চলে। লু-র প্রবল দাপটে মাথা-মুখ ঢেকে বের হতে হচ্ছে। ঘরের পাখার হাওয়া ছাদের গরমকে টেনে নামাচ্ছে। বিছানায় পিঠ পাতলে বুঝি ছেঁকা লাগে! ছাদের ট্যাঙ্কের জল যেন ফোস্কা পড়ে যাচ্ছে। সব মিলিয়ে দাবদাহের জেরে চরম নাকাল বাঁকুড়া, বিষ্ণুপুর, খাতড়া তিন মহকুমার বাসিন্দারাই।
তবে গত বছরের তুলনায় এ বছর গরম এখনও কিছুটা কম। এমনই জানাচ্ছে আবহাওয়া দফতরের বাঁকুড়া কেন্দ্র। তারা জানাচ্ছে, গত বছর ২০ মে-র মধ্যে তাপমাত্রা ৪৫ ডিগ্রিতে সেলসিয়াসে পৌঁছে গিয়েছিল। এ বার এখনও পর্যন্ত ৪৩.১ ডিগ্রি পর্যন্ত পারদ উঠেছে। গতবছর ২১ মে, ২২ মে ও ২৩ মে তাপমাত্রা ছিল যথাক্রমে ৪৫ ডিগ্রি, ৪৪.৩ ডিগ্রি ও ৪১.২ ডিগ্রি। এ বার সেখানে ২১ মে তাপমাত্রা ছিল ৩৯.৮, ২২ মে ছিল ৪৩.১ ও ২৩ মে ছিল ৪২ডিগ্রি।
চলতি মরশুমে জেলায় দাবদাহ শুরু হয়েছে মূলত বুধবার থেকে। ওই দিন জেলার তাপমাত্রা ছিল ৩৭.১ ডিগ্রি। বৃহস্পতিবার আরও প্রায় দু’ডিগ্রি বেড়ে তাপমাত্রা গিয়ে ৩৯.৮ ডিগ্রিতে পৌঁছয়। এরপর এক ধাক্কায় প্রায় চার ডিগ্রি তাপমাত্রা বেড়ে যায় শুক্রবার। ৪৩.১ ডিগ্রি উষ্ণতায় তীব্র দহনে পুড়তে থাকে বাঁকুড়া। ওই দিন ছিল মাধ্যমিকের রেজাল্ট। ফলে মার্কশিট আনতে পথে নামতেই হয় পড়ুয়াদের। সেই সঙ্গে বহু অভিভাবকও ছিলেন। মোটরবাইক বা সাইকেল আরোহীরা তীব্র লু-র দাপটে চরম অস্বস্তিতে পড়েন। ভিজে তোয়ালে, রুমাল মুখে বেঁধে পথে নামছেন মানুষ জন। তাতেও অবশ্য স্বস্তি মেলেনি। কারণ গরম হাওয়ার দাপটে নিমেষে জলে ভেজা কাপড় শুকিয়ে কাঠ।
শনিবারও এই ছবির হেরফের ঘটেনি। সকাল থেকেই রোদ্দুর আগুন হয়ে বর্ষাতে থাকে জেলার মাঠে-প্রান্তরে। এক চিলতে মেঘও আকাশে দেখা যায়নি। তাপমাত্রাও পৌঁছে যায় ৪৩-এ। ক’দিন আগে পর্যন্ত কখনও কালবৈশাখী, কখনও ঝিরিঝিরি বৃষ্টি দাবদাহ থেকে মুক্তি দিয়েছিল। গত এপ্রিল ও চলতি মে মাসে প্রায় আটটি কালবৈশাখী হয়েছে এই জেলায়। বিক্ষিপ্ত বৃষ্টিতে চলতি মাসের শুরু থেকে মঙ্গলবার পর্যন্ত ততটা তপ্ত হয়নি বাঁকুড়ার মাটি। কিন্তু গত কয়েক দিনের দাবদাহেই অস্বস্তি চরমে উঠেছে।
গরমের দাপটে অসুস্থও বাড়ছে। বাঁকুড়া মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের সুপার পঞ্চানন কুণ্ডু বলেন, “ডিহাইড্রেশন, জ্বরে আক্রান্ত হয়ে অনেকেই আমাদের হাসপাতালে আসছেন। গরমের কারণেই এই ধরনের অসুস্থতা বাড়ছে।’’ বাঁকুড়া মেডিক্যালের শিশু চিকিৎসক সোমনাথ নন্দীর কথায়, “গরমে জেলায় ডায়েরিয়ার প্রকোপ বেশ বেড়ে যায়। তবে এ বার এখনও এই ধরনের রোগী খুব একটা পাওয়া যায়নি। তবে গরমের জন্য সর্দি, কাশি, জ্বরে আক্রান্ত হচ্ছে অনেক শিশুই।”
অন্য বছরের মতো এ বারও দাবদাহ থেকে বাঁচতে খুব একটা বাড়ি থেকে বের হচ্ছেন না সাধারণ মানুষ। তাই বেলা একটু গড়াতেই রাস্তাঘাট ফাঁকা ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে। একটু ছায়ার খোঁজে রাস্তার পাশের গাছগুলির তলায় ভিড় জমতে দেখা যাচ্ছে পথচারীদের। জরুরি কাজে বাঁকুড়ায় জেলা ডাকঘরে আসা কাটজুড়িডাঙার বাসিন্দা অনির্বাণ মণ্ডল বলেন, “তীব্র গরমে দিনভর হাঁসফাঁস অবস্থা। চড়া রোদে বাড়ি থেকে বের হওয়াই দায়। বাইক চালানো যাচ্ছে না গরম হাওয়ার দাপটে। মনে হচ্ছে শরীরের খোলা অংশ যেন পুড়ে যাচ্ছে।”
গরমের দাপটে শহরের বহু রিকশ চালকই দুপুরের পর বাড়ি ফিরে যাচ্ছেন। অনেকে দূরের যাত্রীদের নিচ্ছেন না। ফলে যাত্রীরাও সমস্যায় পড়ছেন। অনেক রিকশ চালক আবার মোটা টাকার ভাড়া হাঁকছেন। গরমে অতিষ্ঠ পথচারী তাও মেনে নিচ্ছেন। কেরানিবাঁধ এলাকার বাসিন্দা সবিতা দত্তের কথায়, “সতীঘাটে একটা কাজে গিয়েছিলাম। ফেরার পথে কোনও রিকশই আসতে চাইছিল না গরমের জন্য। অনেক খোঁজাখুজির পরে প্রায় দ্বিগুণ ভাড়ায় এক রিকশ চালক যেতে রাজি হল।”
এই দাবদাহের মধ্যেই আজ রবিবার থেকে বাঁকুড়া জেলা স্কুলে একাদশ শ্রেণিতে ভর্তির আবেদনপত্র বিলি করা শুরু হবে বলে স্কুল সূত্রে জানা গিয়েছে। অভিভাবকদের আশঙ্কা, আবেদনপত্র তোলার লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে ফের এক প্রস্ত গরমের সঙ্গু যুঝতে হবে। এই পরিস্থিতিতে জেলাবাসী চাইছে বৃষ্টি। কিন্তু কবে ঈশান কোণে আকাশে মেঘ জমবে, তার আভাস এখনই দিতে পারছে না হাওয়া অফিস।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy