Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪

বন্দুক নিয়ে ব্যালট লুট

জেলাশাসক মৌমিতা গোদারা বসু বলেন, ‘‘কয়েকটি বুথ থেকে ব্যালট বাক্স লুঠ-সহ নানা সমস্যার অভিযোগ পেয়েছি। তা নির্বাচন কমিশনকে জানানো হচ্ছে। নির্দেশ এলে পুনরায় ভোটগ্রহণ করা হবে।’’

রাইপুরের এই চাকা ১২৪ বুথ থেকে রাইফেল ছিনিয়ে নেওয়ার অভিযোগ ওঠে। নিজস্ব চিত্র

রাইপুরের এই চাকা ১২৪ বুথ থেকে রাইফেল ছিনিয়ে নেওয়ার অভিযোগ ওঠে। নিজস্ব চিত্র

রাজদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়
রাইপুর শেষ আপডেট: ১৫ মে ২০১৮ ০২:২২
Share: Save:

এক জন সশস্ত্র পুলিশ ও লাঠিধারী সিভিক কর্মী দিয়ে নির্বিঘ্নে যে ভোট করানো যাবে না, বিরোধীদের সেই আশঙ্কাই সত্যি হল ভোটের দিন। বাঁকুড়ার জঙ্গলমহল সোমবার সেই ঘটনাই প্রত্যক্ষ করল। পুলিশকে মারধর করে বন্দুক ছিনিয়ে নেওয়া থেকে শুরু করে লুঠ হয়ে গেলে ব্যালট বাক্সও। দুষ্কৃতীদের হাতেম মার খেলেন ভোটকর্মীরাও। তির বিদ্ধ হলেও তিন তৃণমূল কর্মী।

জেলাশাসক মৌমিতা গোদারা বসু বলেন, ‘‘কয়েকটি বুথ থেকে ব্যালট বাক্স লুঠ-সহ নানা সমস্যার অভিযোগ পেয়েছি। তা নির্বাচন কমিশনকে জানানো হচ্ছে। নির্দেশ এলে পুনরায় ভোটগ্রহণ করা হবে।’’

বাঁকুড়া জেলার একমাত্র খাতড়া মহকুমাতেই শাসকদলের সঙ্গেই পাল্পা দিয়ে প্রায় সব আসনে প্রার্থী দিতে পেরেছিল বিরোধীরা। তাই সবার নজরে ছিল জঙ্গলমহল। ভোট শুরুর কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই সেই জঙ্গলমহলের বিভিন্ন এলাকা থেকে গোলমালের খবর আসতে শুরু করে।

এ দিন বেলা ১১টার কিছু পরে রাইপুর থানার চাকার ১২৪ নম্বর বুথে ভোট গণ্ডগোল বেধে যায়। ততক্ষণে ওই বুথে ৮৫০ জনের মধ্যে ২০০ জন ভোটারের ভোট দেওয়া হয়ে দিয়েছে। অভিযোগ ওঠে বিজেপি প্রার্থীর এক এজেন্ট এক ভোটারের হয়ে ভোট দিয়েছেন। এরপরেই বুথের ভিতরে কিছু তৃণমূলের কর্মী ঢুকে পড়ে ওই ভোট বাতিলের দাবি তোলেন। দু’দলের মধ্যে তা নিয়ে বুথের ভিতরেই হাতাহাতি শুরু হয়ে যায়। বাসিন্দারা জানিয়েছে, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলে ভোটকর্মীরা বুথের বাইরে চলে যান। কিছুক্ষণের মধ্যেই বিজেপির লোকজন সরে যায়। ফের ভোট শুরু হয়।

কিন্তু, গণ্ডগোল থামেনি। কিছুক্ষণ পরে সশস্ত্র অবস্থায় কয়েকজন দুষ্কৃতী শূন্যে গুলি ছুড়তে ছুড়তে বুথের মধ্যে ঢুকে পড়েন। নিরাপত্তায় থাকা এক পুলিশ কর্মীকে মারধর করে তাঁর এসএলআর ছিনিয়ে নেয়। মারধর করা হয় ভোটকর্মীদেরও। এরপরেই ওই বন্দুক ও তিনটি ব্যালট বাক্স নিয়ে দুষ্কৃতীরা পালায়। প্রাণ বাঁচাতে ভোটকর্মীরা বুথ থেকে বেরিয়ে এসে তিল খেতের মধ্যে লুকিয়ে পড়েন। খবর পেয়ে পুলিশ বাহিনী গিয়ে উপস্থিত হলে ভোটকর্মীরা বুথে ফেরেন।

প্রিসাইডিং অফিসার ইন্দ্রজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘‘গুলি ছুড়তে ছুড়তে দুষ্কৃতীরা বুথে ঢুকেই পুলিশ কর্মীকে মারধর করে তাঁর বন্দুক ছিনিয়ে নেয়। আমাদেরও মারধর করে। প্রাণ বাঁচাতে দৌড়ে বাইরে বেরিয়ে যাই। ফিরে এসে দেখি ব্যালটবাক্স নেই।’’

পরে তদন্তে রাইপুরের চাকা সংলগ্ন বক্সীতে আসেন অতিরিক্ত জেলা পুলিশ সুপার (গ্রামীণ) বিশপ সরকার, ডিএসপি (ডিইবি) অরুণাভ দাস। পুলিশ কর্মীরা বুথের চারপাশে তল্লাশি শুরু করেন। ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই অবশ্য ওই বুথ সংলগ্ন একটি মাঠ থেকে বন্দুকটি উদ্ধার করা হয় বলে দাবি করে পুলিশ। যদিও ব্যালট বাক্সগুলির হদিস পাওয়া যায়নি। যুব তৃণমূলের ঢেকো অঞ্চল সভাপতি পুলক পাত্রের অভিযোগ, ‘‘বিজেপি আশ্রিত দুষ্কৃতীরাই এই কাণ্ড ঘটিয়েছে।’’

তার আগেই অবশ্য রক্ত ধরেছে বারিকুল থানার শুবনাবাদি বুথের কাছে। সকাল ৯টা নাগাদ বুথের বাইরে জমায়েত করা তৃণমূল কর্মীদের সঙ্গে নির্দল ও বিজেপি কর্মীদের সংঘর্ষ বাধে। তৃণমূলের অভিযোগ, নির্দল ও বিজেপি আশ্রিত দুষ্কৃতীরা তির ছুড়ে তাঁদের তিন কর্মীকে জখম করে। রাইপুর ব্লকের যুব তৃণমূল সভাপতি রাজকুমার সিংহের অভিযোগ, ‘‘ওরা বুথ দখলের চেষ্টা করছিল। আমরা রুখে দিই। তখন ওরা আমাদের কর্মীদের লক্ষ্য করে তির ছোড়ে।’’ পুলিশ জানায়, আহত তিন ব্যক্তিকে বাঁকুড়া মেডিক্যালে পাঠানো হয়েছে।

বাঁকুড়ার শহর লাগোয়া ধলডাঙায় এ দিন বিকেলে এক দল দুষ্কৃতী মোটরবাইকে এসে ব্যালট লুঠের চেষ্টা করে বলে অভিযোগ। সেই সময়ে এলাকাবাসীই তাঁদের ঘিরে ধরে। বাধা পেয়ে পালানোর সময়ে দুষ্ক়ৃতীদের এক জন মোটরবাইক থেকে পড়ে গেলে, তাকে ধরে বেদম মারধর করা হয়। সঙ্গীরা অবশ্য পালিয়েছিল। আশঙ্কাজনক অবস্থায় অজ্ঞাত পরিচয় ওই যুবককে বাঁকুড়া মেডিক্যালে ভর্তি করানো হয়। যুব তৃণমূল সভাপতি শিবাজি বন্দ্যোপাধ্যায়ের দাবি, ‘‘জখম ওই যুবক আমাদের দলের কর্মী। তিনি মোটেই ব্যালট লুঠ করে যাননি। তিনি রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলেন। বিজেপির লোকেরা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে তাঁকে মারধর করে।’’ যদিও বিজেপির রাজ্য নেতা সুভাষ সরকার সেই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।

এ দিন বারিকুল থানার লাগদা বুথের (১২০ নম্বর) ভিতর থেকে নির্দল ও বিজেপির বিরুদ্ধে ব্যালট বাক্স লুঠ করে বাইরে তা ফেলে দেওয়ার অভিযোগ তোলে তৃণমূল। প্রশাসন সূত্রে জানা গিয়েছে, ব্যালট লুঠের অভিযোগ এসেছে রাইপুরের চোরশোল (১২৩/২ নম্বর), খাতড়ার সুপুর এলাকার (১৩ নম্বর) একটি বুথ থেকে। তেমনই তৃণমূলের বিরুদ্ধেও এই মহকুমার বিভিন্ন এলাকা থেকে বুথ জ্যাম করার অভিযোগ তুলেছেন বিরোধীরা।

বিজেপির রাজ্য নেতা সুভাষ সরকার বলেন, ‘‘আমরা জেলার ১২টি বুথে পুর্ননির্বাচন দাবি করেছি।’’ সিপিএমের জেলা সম্পাদক অজিত পতির অভিযোগ, ‘‘গোটা জেলাজুড়েই অবাধ ভোট হয়নি। দক্ষিণ বাঁকুড়ার প্রায় সব বুথেই কমবেশি ছাপ্পা ভোট হয়েছে।’’ তবে ভোটকর্মীদের অনেককেই এ দিন বলতে শোনা গিয়েছে, রাজ্য পুলিশের অধীনে আর নয়, এ বার কেন্দ্রীয় বাহিনী এনে ভোট করালেই ভরসা পাবেন তাঁরা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE