Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪
মেডিক্যালে নালিশ

ফেল কড়ি বেড নাও, বলে দালাল

এ কথা শুনেই প্রণব বুঝে গিয়েছিলেন, তিনি দালালের খপ্পরে পড়ে গিয়েছেন। কিন্তু উপায় ছিল না। টাকার কথা ভাবার থেকে সেই সময়ে তাঁর কাকাকে ওয়ার্ডে নিয়ে যাওয়া বেশি জরুরি ছিল।

প্রতীকী ছবি।

প্রতীকী ছবি।

নিজস্ব সংবাদদাতা
বাঁকুড়া শেষ আপডেট: ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ ০১:১৫
Share: Save:

পেটের রোগে গুরুতর অসুস্থ কাকাকে নিয়ে হন্তদন্ত হয়ে বাঁকুড়া মেডিক্যাল কলেজের জরুরি বিভাগে ছুটে এসেছিলেন শালতোড়ার প্রণব রায়। জরুরি বিভাগের ডাক্তার রোগীকে দেখেই হাসপাতালে ভর্তি করতে বলেন। আর তার পর থেকেই ভোগান্তির পর্ব শুরু।

কেমন ভোগান্তি?

প্রণবের অভিযোগ, “ডাক্তারবাবু কাকাকে ভর্তি করার কথা লিখে দিয়েই, আমাকে বলেন— ‘যান, ওয়ার্ড মাস্টারের অফিস থেকে ট্রলি নিয়ে আসুন। রোগীকে ওয়ার্ডে নিয়ে যেতে হবে। কিন্তু এ কাজ তো স্বাস্থ্যকর্মীদের! তবে ডাক্তারবাবুকে সে প্রশ্ন করার সাহস পাইনি।” অগত্যা ওয়ার্ড মাস্টারের অফিসে গিয়ে তিনি ট্রলির খোঁজ করেন। সেখানে তাঁর নতুন অভিজ্ঞতা। তিনি জানান, ট্রলির খোঁজে যখন এদিক ওদিক ঘুরে বেড়াচ্ছেন, ঠিক সেই সময়েই হাফপ্যান্ট পরা এক যুবক এগিয়ে জানতে চান— ‘‘কী হয়েছে’’? প্রণব বলেন, “ট্রলি খুঁজছি বলতেই ওই যুবক সটান জানিয়ে দেন, ৩০০ টাকা ফেললেই ট্রলি এসে পড়বে। কয়েক জন ছেলে রোগীকে বয়ে নিয়ে গিয়ে ওয়ার্ডে পৌঁছেও দেবে।”

এ কথা শুনেই প্রণব বুঝে গিয়েছিলেন, তিনি দালালের খপ্পরে পড়ে গিয়েছেন। কিন্তু উপায় ছিল না। টাকার কথা ভাবার থেকে সেই সময়ে তাঁর কাকাকে ওয়ার্ডে নিয়ে যাওয়া বেশি জরুরি ছিল। বাধ্য হয়েই প্রণব তাঁদের সঙ্গে দরাদরি শুরু করেন। শেষে ২৫০ টাকায় ওই যুবককে রাজি করান। মিনিট দু’য়েকের মধ্যেই ওই যুবক ট্রলি ও তিন জন যুবককে নিয়ে হাজির!

প্রণব ব্যতিক্রম নন। তাঁর মতোই বাঁকুড়া মেডিক্যালে এসে প্রায়শই নানা ভাবে দালালদের খপ্পরে পড়েন রোগীর পরিজনেরা। রোগী ভর্তি করা থেকে ওয়ার্ড থেকে সিটি স্ক্যান বা এক্স-রে করাতে নিয়ে যাওয়ার সময়েও একই ভাবে কড়ি গুনে লোক জোটাতে হয়।

দালালদের হাত যে কত দূর, তা নিয়েও রোগীর পরিজনদের জল্পনার শেষ নেই। হাসাপাতালের বেডে রোগীতে ভর্তি। কনকনে ঠান্ডায় মেঝেতে অসুস্থ প্রিয়জন পড়ে রয়েছে। ফিসফিস করে দালাল এসে বলে— ‘‘বেড পাননি বলে মন খারাপ?’’ কড়ি ফেললেই, ফাঁকা বেড মিলে যায় বলেও অভিযোগ।

বাঁকুড়া মেডিক্যালের বহির্বিভাগে দালাল-রাজ প্রকাশ্যে এসেছে বহু বার। হাসপাতালের টিকিট করিয়ে দেওয়া থেকে দ্রুত এক্স-রে করিয়ে দেওয়া তো বটেই, ডাক্তার সেজে আউটডোরে দালালেরা রোগীদের চিকিৎসা করাচ্ছেন, এমন অভিযোগও উঠেছে অতীতে। তবে অন্তর্বিভাগেও দালাল চক্রের সক্রিয়তাও কোনও অংশে কম নয়।

খোদ ওয়ার্ড মাস্টারের দফতরের সামনে প্রকাশ্যেই দাপিয়ে বেড়ায় দালালেরা, অথচ কারও নজরে পড়ছে না কেন? এই প্রশ্ন তুলে রোগীর পরিজনদের আক্ষেপ, রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সাধারণ মানুষকে বিনামূল্যে চিকিৎসা পরিষেবা দিচ্ছেন। হাসপাতাল থেকে মিলছে ওষুধপত্রও। তাহলে কেন দালাল চক্রের গেরোয় পড়ে টাকা খোয়াতে হবে দুঃস্থদের?

হাতেনাতে: হাসপাতালের কর্তার নামে ভুয়ো সিলমোহর তৈরি করে চিরকুট পাঠানো হয়েছিল আউটডোরের ডাক্তারকে।

দালাল-রাজ বন্ধ না হওয়ার জন্য মূলত দু’টি কারণকে দায়ী করছেন হাসপাতালের আধিকারিকদের একাংশ। প্রথমত, যথেষ্ট পরিমাণে চতুর্থ শ্রেণির কর্মী না থাকা। দ্বিতীয়ত, হাসপাতালের ঢিলেঢালা নিরাপত্তা ব্যবস্থা। হাসপাতালের এক আধিকারিক বলেন, “যাঁরা দালাল, তাঁরা বেশির ভাগই নিখরচায় হাসপাতালের এক শ্রেণির আধিকারিকের ফাইফরমাস খাটেন। মূলত সে কারণেই ওই সব লোকজন হাসপাতালের ভিতরে অবাধে ঢুকে পড়ছে। তাদের কাছ থেকে সুবিধা নেওয়া আধিকারিকেরাও সব দেখেও তাই চোখ বন্ধ করে থাকছেন।’’

দালালচক্র যে চলছে তা স্বীকার করছেন হাসপাতালের কর্তারাও। এই সব রুখতে কী ব্যবস্থা নিচ্ছেন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ?

বাঁকুড়া মেডিক্যালের অধ্যক্ষ পার্থপ্রতিম প্রধান বলেন, “হাসপাতালের পরিকাঠামোর উন্নয়নই দালালচক্র রোখার একমাত্র পথ। আমাদের হাতে এই মুহূর্তে চতুর্থ শ্রেণির কর্মী রয়েছে মোটে ৬০ জন। সংখ্যাটা অন্তত ২৫০ হলে যথাযথ পরিষেবা দেওয়া সম্ভব। কর্মী নিয়োগ নিয়ে স্বাস্থ্য ভবনের সঙ্গে আমাদের আলোচনা চলছে।”

বাঁকুড়ার অতিরিক্ত জেলাশাসক (স্বাস্থ্য) নবকুমার বর্মন বলেন, ‘‘বাঁকুড়া মেডিক্যালে দালালচক্রের অভিযোগ মাঝে মধ্যেই শোনা যায়। এ নিয়ে হাসপাতালে কয়েকবার বৈঠক হয়েছে। দালালচক্র রুখতে এ বার প্রশাসনিক অভিযান চালানো হবে।’’ তিনি জানান, ইতিমধ্যে মহকুমাশাসককে (সদর) বিষয়টি দেখতে বলা হয়েছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Bankura Medical College Middleman Bed Crisis
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE