ফল ঘোষণার পরে ঝাঁপ বন্ধ কংগ্রেস কার্যালয়ে। ছবি: অনির্বাণ সেন।
লালমাটির বীরভূমে বামেদের প্রবল দাপটেও অক্ষুণ্ণ ছিল তাদের গড়। অন্য তিনটি পুরসভায় বামেদের থেকেও ভাল ফল করেও সিউড়ি থেকে শূন্য হাতেই ফিরলেন দলীয় কর্মী-সমর্থকেরা। মঙ্গলবার ভোটের ফলে আনুষ্ঠানিক ভাবে সাঁইথিয়া শহর থেকে ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে গেল কংগ্রেস!
অথচ গত পুরভোটেও বারোটি আসন পেয়ে সাঁইথিয়ায় বোর্ড গড়েছিল কংগ্রেসই। কিন্তু, এ বার ১৬ আসনের পুরসভায় তৃণমূল পেল ১৩ এবং বিজেপি ৩টি ওয়ার্ড। কংগ্রেস এবং বাম দু’জনেই খাতা খুলতে পারেনি। দলের এই হাল কেন? কংগ্রেস জেলা সভাপতি সৈয়দ সিরাজ জিম্মির দাবি, ‘‘সন্ত্রাস, টাকা আর ছাপ্পা ভোটের কাছে কংগ্রেস হেরে গিয়েছে। সেই সঙ্গে ওই শহরে নীহার দত্তের পরিবারের একটা প্রভাব তো আছেই।’’
ঘটনা হল, প্রবল বাম জমানাতেও যাঁর নেতৃত্বে এই শহর কংগ্রেসের গড়ে পরিণত হয়, সেই দীর্ঘ দিনের প্রাক্তন জেলা কংগ্রেস সভাপতি, প্রয়াত নীহার দত্ত-কে সাঁইথিয়ার রাজনীতিতে এড়িয়ে চলা মুশকিল। ১৯৯৪ সালে এই শহরে প্রথম পুরভোট হয়। এগারো আসনের সব ক’টিই ছিনিয়ে নেয় কংগ্রেস। সেই থেকে কংগ্রেসকে এই শহরে আর কোনও দিন ফিরেও তাকাতে হয়নি। সেই নীহারবাবুর মৃত্যুর পরে জেলার অন্য পুরসভাগুলিতে কংগ্রেসে ভাঙন ধরলেও এই শহরে দলের দাপট অক্ষতই ছিল। সেখানে দলের হাল ধরেছিলেন তাঁরই পুত্রেরা। বিরোধীরা কখনই তিন বা চারে বেশি আসন পায়নি। এমনকী, গত পুরভোটেও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি।
কিন্তু, ছবিটা পাল্টাতে শুরু করে বছর দেড়েক আগে নীহারবাবুর ছেলে ১৫ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর বিপ্লব দত্ত দলের ১১ জন কাউন্সিলরকে সঙ্গে নিয়ে তৃণমূলে যোগ দেওয়ার পরে। তাঁর নেতৃত্বে দুই বাম কাউন্সিলরও তৃণমূলে যোগ দেয়। মাত্র একটি আসনে জয়ী হওয়া তৃণমূলের হাতেই চলে যায় পুরবোর্ডের ক্ষমতা। শহরে দলের এক প্রবীণ কর্মীর আক্ষেপ, ‘‘কার্যত তখনই বীরভূমে কংগ্রেসের গড় বলে পরিচিত সাঁইথিয়ায় কংগ্রেসের কফিনে শেষ পেরেকটি পোতা হয়ে যায়। আজ, আনুষ্ঠানিক ভাবে সাঁইথিয়া কার্যত কংগ্রেস-শূন্য হয়ে গেল!’’
এ দিকে, পুরভোটে শেষ দিন প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরী সাঁইথিয়ায় সভা করেছিলেন। সেখানে তিনি বলেছিলেন, ‘‘প্রয়াত নীহার দত্ত-কে আমি আজও শ্রদ্ধা করি। কিন্তু, তাঁর ছেলেরা বাবার সম্মান রাখেননি। দলের দুঃসময়ে তৃণমূলে চলে গিয়ে বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন।’’ ওই দিন আরও বলেন, ‘‘যাঁরা দল বদল করেছেন, তাঁদের ভোটে জিতে আসা উচিত।’’ সেই চ্যালেঞ্জে কার্যত লেটার পেয়ে উত্তীর্ণ হয়েছেন দলত্যাগীরা। এ দিন ফল ঘোষণার পরে দেখা যাচ্ছে, শহরের ক্ষমতার কেন্দ্রে রয়ে গেলেন সেই নীহারবাবুর পরিবার। এ বারও সাঁইথিয়া ১৫ নম্বর ওয়ার্ডের প্রার্থী ছিলেন ছোট ছেলে বিপ্লব দত্ত। তাঁর প্রাপ্য ভোট ১,৯১৯। বিপক্ষে বিজেপি ১৯৮, বামফ্রন্ট ৩১ এবং কংগ্রেস মাত্র ১৭টি ভোট পেয়েছে। ১,৭২১ ভোটের ব্যবধানে জিতেও বিজেপি-র কাছে শহরের তিনটি আসন হাতছাড়া হওয়ায় আফশোস যাচ্ছে না বিপ্লববাবুর। দুপুরে সিউড়ির ভোট গণনা কেন্দ্র থেকে বেরিয়েয়ে তিনি বললেন, ‘‘একটা আসন হাতছাড়া হতে পারে বলে আমাদেরও ধারণা ছিল। কিন্তু, তিনটি আসনে আমাদের প্রার্থীরা হেরে যাবেন, তা ভাবতে পারিনি। তাই মনের গভীরে একটা ক্ষত রয়েই গেল!’’
শহরে এ বার রেকর্ড মার্জিনে জিতেছেন ৭ নম্বর ওয়ার্ডের তৃণমূল প্রার্থী শান্তনু রায়। তাঁর প্রাপ্য ভোট ২,১০৭। জয়ের ব্যবধান ১৮১৪। গত পুরভোটে এই ওয়ার্ড থেকেই জিতে শান্তনুবাবু তৃণমূলের একমাত্র বিজয়ী প্রার্থী ছিলেন। বিরোধীদের এমন হাল কেন? সদ্য দায়িত্বে আসা সিপিএমের জেলা সম্পাদক রামচন্দ্র ডোমের দাবি, ‘‘সাঁইথিয়ায় দলের এমন ফলের প্রথম শাসকদলের সন্ত্রাস, টাকা ও ছাপ্পা ভোট।’’ পাশাপাশি দলের সাংগঠনিক দুর্বলতাও যে হারের অন্যতম কারণ, তা তিনি মেনে নিয়েছেন। অন্য দিকে, বিজেপি-র জেলা আহ্বায়ক অর্জুন সাহা বলছেন, ‘‘বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি অনুযায়ী বলছি, সন্ত্রাস না হলে এ বার বিজেপিই সাঁইথিয়ায় বোর্ড গড়ত।’’
যা শুনে উড়িয়েই দিচ্ছেন তৃণমূল জেলা সভাপতি অনুব্রত মণ্ডল। তাঁর পাল্টা দাবি, ‘‘বিরোধীদের অভিযোগ সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। তৃণমূল ছাপ্পা ভোট করেনি। জেলায় কোনও সন্ত্রাসও হয়নি। তা না হলে বিরোধীরা একটি আসনও পেত না।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy