Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪
প্রশ্নে ‘নির্মল’ পঞ্চায়েত

ঘোষণার পরে নির্মাণের ইট পড়ল উপভোক্তার ঘরে

সরকারি খাতার হিসেব বলছে, তাঁর বাড়িতে সেই কবেই শৌচালয় গড়ে দিয়েছে প্রশাসন। এলাকায় গিয়ে দেখা যাচ্ছে, ‘তৈরি’ হয়ে যাওয়া সেই শৌচালয়টিই গ়ড়তে মঙ্গলবার প্রথম ওই উপভোক্তার বাড়িতে ইট-বালি-সিমেন্ট ফেলেছে ঠিকাদার সংস্থা! বীরভূম প্রশাসনের ‘নির্মল পঞ্চায়েত’ প্রকল্পের সাফল্যের খতিয়ানকে প্রশ্নের মুখে ফেলে দিচ্ছে এই একটি ঘটনাই।

পড়ে রয়েছে ইট। —নিজস্ব চিত্র

পড়ে রয়েছে ইট। —নিজস্ব চিত্র

নিজস্ব সংবাদদাতা
রামপুরহাট শেষ আপডেট: ৩০ নভেম্বর ২০১৬ ০০:৫২
Share: Save:

সরকারি খাতার হিসেব বলছে, তাঁর বাড়িতে সেই কবেই শৌচালয় গড়ে দিয়েছে প্রশাসন। এলাকায় গিয়ে দেখা যাচ্ছে, ‘তৈরি’ হয়ে যাওয়া সেই শৌচালয়টিই গ়ড়তে মঙ্গলবার প্রথম ওই উপভোক্তার বাড়িতে ইট-বালি-সিমেন্ট ফেলেছে ঠিকাদার সংস্থা!

বীরভূম প্রশাসনের ‘নির্মল পঞ্চায়েত’ প্রকল্পের সাফল্যের খতিয়ানকে প্রশ্নের মুখে ফেলে দিচ্ছে এই একটি ঘটনাই। দু’দিন আগেই ঢাকঢোল পিটিয়ে নতুন করে এই জেলার ১৬৭টির মধ্যে ৫৩টি পঞ্চায়েতকে ‘নির্মল’ পঞ্চায়েতের তকমা দিয়েছে জেলা প্রশাসন। যে তালিকায় নাম রয়েছে রামপুরহাট ১ পঞ্চায়েত সমিতির অন্তর্গত বনহাট পঞ্চায়েতের। আর ওই পঞ্চায়েতের বিরুদ্ধেই এমন করে ‘নির্মল বাংলা’ প্রকল্পের সরকারি টাকা নয়ছয় করার অভিযোগ উঠেছে। বিরোধীদের কটাক্ষ, বনহাটের ঘটনা আদতে হিমশৈলের চূড়া মাত্র। নিরপেক্ষ তদন্ত হলে সরকারি প্রকল্পের দুর্নীতি নিয়ে ঠগ বাঝতে গা উজাড় হয়ে যাবে।

তবে ওই পঞ্চায়েতের বিরুদ্ধে যে এ দিনই প্রথম অভিযোগ উঠেছে, তা নয়। ‘নির্মল বাংলা’ প্রকল্পে শৌচালয় নির্মাণে দুর্নীতির অভিযোগ তুলে সম্প্রতি সম্প্রতি এসডিও-র (রামপুরহাট) দ্বারস্থ হয়েছিলেন পঞ্চায়েতের জেদুর গ্রামের বাসিন্দাদের একাংশ। তাঁদের লিখিত অভিযোগের ভিত্তিতে দুর্নীতির তদন্ত শুরু করেছিলেন রামপুরহাট ১ বিডিও নীতিশ বালা। বিডিও নিজে মানছেন, ‘‘তদন্তে অভিযোগের কিছু সত্যতা মিলেছে। বেশ কিছু ক্ষেত্রে শৌচালয় নির্মিত হয়নি। অথচ সরকারের ঘর থেকে নির্মাণের জন্য নির্ধারিত উপভোক্তাদের প্রয়োজনীয় ইট-বালি ও অন্যান্য উপকরণ দেওয়ার টাকা তুলে নেওয়া হয়েছে।’’ বিডিও-র কথাতেই স্পষ্ট হয়েছে, প্রশাসনের তদন্তে ওই পঞ্চায়েত এখনও ‘ক্লিনচিট’ পায়নি। অথচ পঞ্চায়েতটি যাতে অভিযুক্ত, সে-ই প্রকল্পেই ‘সফল’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে প্রশাসন। প্রশ্ন উঠেছে, ঠিক কোন যুক্তিতে ওই পঞ্চায়েতকে ‘নির্মল’ বলে ঘোষিত করল প্রশাসন?

এ দিকে, মধু কোনাই নামে জেদুর গ্রামের এক বাসিন্দা ওই প্রকল্পের দুর্নীতি নিয়ে এ দিন বিকালে ফের সরব হয়েছেন। তাঁর দাবি, ‘‘মাসখানেক আগে জানতে পারি, কাগজকলমে আমার নামে শৌচালয় তৈরি হয়ে গিয়েছে। প্রশাসনের কাছে অভিযোগ দায়ের করি। ব্লক প্রশাসনের প্রমাণিত হয়, আমার বাড়িতে কোনও শৌচালয় তৈরি হয়নি।’’ সেই প্রমাণ মেলার পরেও এখনও পর্যন্ত অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে কী পদক্ষেপ করা হয়েছে, প্রশাসন অবশ্য তা তাঁকে জানায়নি। এরই মাঝে এ দিন দুপুরে ঠিকাদারের লোকেরা তাঁর বাড়িতে শৌচালয় নির্মাণের জন্য প্রয়োজনীয় ইট ও বাকি উপকরণ ফেলতে আসে। তাতে বাধা দেন মধুবাবুর পরিবার। তাঁর বক্তব্য, ‘‘আমার সন্দেহ, দুর্নীতি ঢাকতেই এখন ওদের এত সক্রিয়তা। প্রশাসন আগে দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিক। তার পর এ সব হবে।’’

এলাকার তৃণমূল পঞ্চায়েত সদস্য উত্তম চট্টোপাধ্যায়ের যদিও দাবি, ‘‘সমস্ত অভিযোগই মিথ্যা। কোনও দুর্নীতি হয়নি। প্রশাসনের তদন্তেই তা প্রমাণিত হয়েছে।’’ যদিও একই গ্রামের বাসিন্দা অশোক কোনাইয়ের অভিযোগ, স্থানীয় পঞ্চায়েত সদস্য ঘটনা আড়াল করার চেষ্টা করছেন। অথচ প্রশাসনের তদন্তে এটা আগেই প্রমাণিত হয়েছে যে, মাস্টাররোলে নাম থাকা যাদের বাড়িতে শৌচাগার গড়া হয়ে গিয়েছে বলে তালিকা দেওয়া হয়েছিল, সেই সব উপভোক্তার অনেকেরই বাড়িতে এখনও কোনও শৌচাগার নেই। দু’জনেই বলছেন, ‘‘দুর্নীতির অভিযোগ যদি ঠিকই না হয়, তা হলে এখন কেন প্রতারিত উপভোক্তাদের বাড়িতে শৌচালয় নির্মাণের উপকরণ ফেলা হচ্ছে?’’ উত্তর দিতে পারেননি তৃণমূল পরিচালিত বনহাট পঞ্চায়েতের প্রধান বুবাই মুর্মু। এ দিন দুপুরে ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি শুধু বলেন, ‘‘এখন পঞ্চায়েতে যাচ্ছি। সেখানে যাওয়ার পরে উত্তর দেব।’’ পরে একাধিকবার তাঁকে ফোন করা হলেও তিনি ধরেননি।

এত কিছুর পরেও অভিযুক্ত পঞ্চায়েত কী করে ‘নির্মল’ পঞ্চায়েতের তকমা পেল? বিডিও-র বক্তব্য, ‘‘ওই পঞ্চায়েতে তো শৌচালয় নির্মাণের ৯৯ শতাংশ কাজ শেষ।’’ কিছু ‘কাজ’ বাকি রেখেই কী করে ওই পঞ্চায়েত ‘নির্মল’ হয়ে গেল, তার সদুত্তর অবশ্য জেলা প্রশাসনের কর্তারা দিতে পারছেন না। জেলাশাসক পি মোহন গাঁধী কেবল বলেন, ‘‘এটা পাইলট প্রজেক্ট। কোথাও সমস্যা হয়ে থাকলে খতিয়ে দেখা হবে।’’

প্রশাসনের ওই জবাবে যদিও সন্তুষ্ট নয় বিরোধীরা। সিপিএমের জেলা কমিটির সদস্য সঞ্জীব বর্মনের কটাক্ষ, ‘‘তৃণমূল পরিচালিত ওই পঞ্চায়েতে সরকারি প্রকল্পের নামে পুকুর চুরি চলছে। অথচ ওই পঞ্চায়েতকেই ‘নির্মল’-এর তকমা দিয়েছে জেলা প্রশাসন। যা দেখছি, তাতে কেঁচো খুঁড়তে না সাপ বেরিয়ে পড়ে!’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE