আশা: শিল্প-বান্ধব পরিকাঠামোর জন্য তৈরি হচ্ছে রাস্তা। —নিজস্ব চিত্র।
ঘামে ভেজা শরীরগুলো বেয়ে ঝরে পড়ত বিশ্বকর্মা পুজোর আলো রোশনাই। বন্ধ কারখানার সেই সব কাজ হারানো শ্রমিকদের মুখ এখন শুকনো। বিশ্বকর্মা পুজো এসেছে। কিন্তু, আলোর সেই রোশনাই আর নেই। বিষ্ণুপুরের দ্বারিকা শিল্পাঞ্চলের ১০টির মধ্যেই পাঁচটি কারখানাই ঝাঁপ গুটিয়েছে। যে পাঁচটি চলছে, সেগুলি নিয়েও অনিশ্চয়তায় শ্রমিকেরা।
আশির দশকের মাঝামাঝি ওয়েস্ট বেঙ্গল ইন্ডাস্ট্রিয়াল ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশন ‘বিষ্ণুপুর ইন্ডাস্ট্রিয়াল গ্রোথ সেন্টার’ তৈরি করতে উদ্যোগী হয়। বিষ্ণুপুর শহরের উপকণ্ঠে দ্বারিকা-গোসাঁইপুর পঞ্চায়েত এলাকায় জমি অধিগ্রহণ শুরু হয়। দ্বারিকা, শ্যামসুন্দরপুর, অবন্তিকা ও বিষ্ণুপুরের বাসিন্দারদের জমি নেওয়া নিয়ে কম ঝামেলা হয়নি।
নয়ের দশকে প্রথমে প্রায় ১৯৬ একর জায়গা জুড়ে শিল্প তালুকের পথচলা শুরু হয়। বাসিন্দারা জানাচ্ছেন, প্রথমে একটি সিসা তৈরির কারখানা চালু হয়। পরে এক এক করে ফেরোঅ্যালয়, সিমেন্ট, মুরগির খাবার তৈরির কারখানার দরজা খোলে। সরকারি ভর্তুকি নিয়ে ১০টি কারখানা চালু হয়।
কর্মসংস্থান হলেও কারখানায় ধোঁয়া নিয়ে দূষণের বিস্তর অভিযোগ ওঠে। তারপরে যে ভাবে জ্বলে উঠেছিল কারখানার আলো, একে একে নিভেও গেল তেমনই।
‘‘এখন কোনও রকমে কয়েকটি কারখানা ধুঁকতে ধুঁকতে চলেছে। যে কোনও সময় বন্ধ হয়ে পারে।’’— বিশ্বকর্মা পুজোর আগের দিন রবিবার এমনই আশঙ্কার কথা শোনালেন একটি সিমেন্ট কারখানার প্ল্যান্ট সুপার ভাইজর মোহনলাল শর্মা। তাঁর দাবি, ‘‘বহুজাতিক সিমেন্ট কোম্পানিগুলির সঙ্গে এখন বাজার ধরার লড়াইয়ে টিকে থাকাই কঠিন। খরচ এত বেড়েছে, ক’দিন চালানো যাবে?’’
কাজ হারানো শ্রমিক দ্বারিকা গ্রামের তেলিপাড়ার প্রশান্ত নন্দী, বাসুদেব নন্দীরা বলেন, ‘‘জমির উপরে কারখানা তৈরি হল। ক’টা বছর কাজও পেলাম। কিন্তু, কারখানা বন্ধ হয়ে গেল। জমিও ফিরে পেলাম না। সংসার চালাতে জেরবার হয়ে যাচ্ছি।’’শুধু দ্বারিকা গ্রামই নয়, আশপাশের শ্যামসুন্দরপুর, দেউলি, সুভাষপল্লি, অবন্তিকা, বনমালিপুর, জয়কৃষ্ণপুর, জয়রামপুর থেকে তিন শিফটে হাজার-হাজার শ্রমিক এই শিল্প তালুকে কাজে আসতেন। কাজ হারিয়েছেন তাঁদের অনেকেই।
দ্বারিকার বাসিন্দা কাজ হারানো শ্রমিক লক্ষ্মণ চক্রবর্তী এখন পান গুমটি চালান। তাঁর সঙ্গে আবদুল খান, আসগার খান, দুর্গা বাউরি বলেন, ‘‘বিশ্বকর্মা পুজো এলে বুকটা মোচড় দিয়ে ওঠে। বছর পাঁচেক আগেও বিশ্বকর্মা পুজোয় শিল্পতালুক আলোয় সেজে উঠত। বড় বড় শামিয়ানা ও মণ্ডপ তৈরি হত। গান-বাজনা হত। এলাহি খাবারের আয়োজন থাকত। ছেলেমেয়ে, স্ত্রীকে কারখানায় নিয়ে এসে সে সব দেখাতাম।’’ সে সব এখন ফিকে। ধুঁকতে থাকা কারখানাগুলিতে নমো নমো করে বিশ্বকর্মার পুজো হয়। অনেক শ্রমিক এখন ভিন রাজ্যে রাজমিস্ত্রির সহকারী কিংবা হোটেলের রাঁধুনির কাজে গিয়েছেন। কেউ কেউ ইঞ্জিন ভ্যান ভাড়া নিয়ে দ্বারকেশ্বর নদ থেকে বালি তুলে বিষ্ণুপুর শহরে বিক্রি করছেন।
ওই শ্রমিকদের একাংশ কারখানা বন্ধের জন্য রাজনৈতিক দলগুলির ইউনিয়নবাজি ও মালিকপক্ষের কারখানা চালানোর সদিচ্ছার অভাবকেই দুষছেন। যদিও মালিকপক্ষের একাংশের দাবি, একই জেলায় বড়জোড়া, মেজিয়া, গঙ্গাজলঘাটির তুলনায় দ্বারিকায় বিদ্যুতের দাম বেশি নেওয়া হচ্ছে। তাই প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়েছে।
তবে আশার আলো দেখাচ্ছেন বিষ্ণুপুর শিল্প বিকাশ কেন্দ্রের এগজিকিউটিভ ইঞ্জিনিয়ার মহাদেব সরকার। তিনি বলেন, ‘‘শিল্প তালুকের পরিকাঠামো উন্নতিতে নজর দেওয়া হয়েছে। শিল্পতালুক জুড়ে ঢালাইয়ের চওড়া রাস্তা তৈরি করা হচ্ছে। পুরনো রাস্তাগুলিও সংস্কার করা হচ্ছে। নিকাশি নালা, পর্যাপ্ত পানীয় জলের ব্যবস্থা করা থেকে রাস্তার ধারে ফুটপাত, যানবাহন রাখার ছাউনি তৈরি করা হচ্ছে।’’ বিষ্ণুপুর শিল্প বিকাশ কেন্দ্র সূত্রে দাবি করা হয়েছে, এরই মধ্যে রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে প্রতিটি বন্ধ কারখানা কর্তৃপক্ষকে নোটিস করা হয়েছে, হয় কারখানা চালু করুন, নয়তো জমি ফেরত দিতে হবে। কারখানায় অনির্দিষ্ট কালের জন্য তালা ঝুলিয়ে জমি আটকে রাখা যাবে না। কারণ ইতিমধ্যেই দ্বারিকায় শিল্পস্থাপনের প্রস্তাবও আসতে শুরু করেছে।
কাজ হারানো শ্রমিকেরা অবশ্য না আঁচিয়ে ভরসা করতে চাইছেন না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy