Advertisement
১৭ এপ্রিল ২০২৪

শত্রুতায় খুন, বলছে দুই পরিবারই

বিজেপির জেলা সভাপতি বিদ্যাসাগর চক্রবর্তী জানাচ্ছেন, নিহত দীপক তাঁদের বুথ কমিটির সহ-সভাপতি এবং লালমোহন কিসান মোর্চার সদস্য ছিলেন। সংঘর্ষে আহত হন লালমোহনের ছোট ছেলে নৃপেন মাহাতো। অভিযুক্ত পক্ষেরও চার জন আহত হন। সবাইকেই বুধবার রাতে পুরুলিয়া সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। বৃহস্পতিবার অভিযুক্ত তিন আহতকে বাঁকুড়া মেডিক্যালে স্থানান্তর করা হয়।

শোকার্ত: টুরুহুলু গ্রামের বাড়িতে দীপকের মা পরিবালা ও স্ত্রী রানিবালা। বৃহস্পতিবার। ছবি: সুজিত মাহাতো

শোকার্ত: টুরুহুলু গ্রামের বাড়িতে দীপকের মা পরিবালা ও স্ত্রী রানিবালা। বৃহস্পতিবার। ছবি: সুজিত মাহাতো

সমীর দত্ত
কেন্দা শেষ আপডেট: ১৩ জুলাই ২০১৮ ০২:৩০
Share: Save:

কেন্দার জোড়া খুনের ঘটনা দুই পরিবারের পুরনো বিবাদেরই জের বলে জানাচ্ছে পুরুলিয়া জেলা পুলিশ। নিহতদের পরিবারও তার বিরোধিতা করছে না। যদিও নিহত বাবা ও ছেলে তাঁদের দলের কর্মী বলেই দাবি করে বিজেপি নেতৃত্ব প্রতিবাদ জানাতে জেলাজুড়ে আন্দোলনের কথা ঘোষণা করেছে বৃহস্পতিবার। তৃণমূল নেতৃত্বের দাবি, পারিবারিক বিবাদকেও বিজেপি রাজনীতির রং দিচ্ছে।

বুধবার বিকেলে কেন্দা থানার টুরুহুলু গ্রামে দু’টি পরিবারের লোকেদের মারপিটে মৃত্যু হয় লালমোহন মাহাতো (৬২) ও তাঁর ছেলে দীপক মাহাতোর (৩৮)। বিজেপির জেলা সভাপতি বিদ্যাসাগর চক্রবর্তী জানাচ্ছেন, নিহত দীপক তাঁদের বুথ কমিটির সহ-সভাপতি এবং লালমোহন কিসান মোর্চার সদস্য ছিলেন। সংঘর্ষে আহত হন লালমোহনের ছোট ছেলে নৃপেন মাহাতো। অভিযুক্ত পক্ষেরও চার জন আহত হন। সবাইকেই বুধবার রাতে পুরুলিয়া সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। বৃহস্পতিবার অভিযুক্ত তিন আহতকে বাঁকুড়া মেডিক্যালে স্থানান্তর করা হয়।

নিহতদের পরিবারের তরফে বিরিঞ্চি মাহাতো, পান্নালাল মাহাতো, গুরুপদ মাহাতো, সুনীল মাহাতো, রামকৃষ্ণ মাহাতো এবং রাজেন মাহাতোর বিরুদ্ধে খুনের অভিযোগ দায়ের করা হয়। প্রথম চার জন সহোদর ভাই। রামকৃষ্ণ বিরিঞ্চির ছেলে এবং রাজেন পান্নালালের ছেলে। অভিযোগের ভিত্তিতে পুলিশ পান্নালালকে বুধবার রাতেই গ্রেফতার করে। এ দিন পুরুলিয়া আদালত তাকে চার দিন পুলিশ হেফাজতের নির্দেশ দেয়। অন্য দুই অভিযুক্ত সুনীল ও রাজেন পলাতক। বিরিঞ্চি, গুরুপদ ও রামকৃষ্ণের চিকিৎসা চলছে।

পুরুলিয়ার জেলা পুলিশ সুপার আকাশ মাঘারিয়া বলেন, ‘‘গ্রাম্য বিবাদের জেরেই সংঘর্ষ। জোড়া খুনের অভিযোগে এক জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তবে এখনও পর্যন্ত তদন্তে ঘটনার সঙ্গে রাজনীতির কোনও যোগ পাওয়া যায়নি।’’ একই মত জেলা তৃণমূল সভাপতি শান্তিরাম মাহাতোরও। তিনি দাবি করেন, ‘‘এটা দুই পরিবারের লড়াই। কিন্তু, বিজেপি রাজনৈতিক ফায়দা লোটার জন্যে এর মধ্যে রাজনীতির রং লাগাচ্ছে।’’

বিজেপির রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষের দাবি, ‘‘আমরা লাশের রাজনীতি করি না। আমরা বন্‌ধের রাজনীতি করি না। ভাঙচুরের রাজনীতি করি না।’’ যদিও বিজেপির রাজ্য সাধারণ সম্পাদক সায়ন্তন বসুর দাবি, ‘‘পুলিশ ও তৃণমূল প্রচার করছে, বিজেপিরই লোকই আমাদের দলের দুই কর্মীকে খুন করেছে। মানুষের কাছে গিয়ে আসল তথ্য তুলে ধরব।’’ তাঁর দলেরই জেলা সভাপতি দাবি করেছেন, ‘‘হতেই পারে পারিবারিক বিবাদ। কিন্তু, যাঁরা খুন হলেন তাঁরা আমাদের দলেরই কর্মী। আততায়ীরা ভাবছে, বিজেপি কর্মীকে খুন করা হলে তাঁকে কেউ ছোঁবে না।’’

এ দিন ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায়, নিহতদের বাড়ির দেওয়ালে বিজেপির ভোটের প্রচারের দেওয়াল লেখা রয়েছে। অভিযুক্তদের বাড়িতেও বিজেপির পতাকা টাঙানো। তাহলে তৃণমূলকে জড়ানো হচ্ছে কেন? বিজেপির জেলা সভাপতির দাবি, ‘‘ওদের বাড়িতে পতাকা থাকতেই পারে। আমাদের একটাই বক্তব্য, দুই কর্মীকে খুনে যারা জড়িতে, তারা যেই হোক, পুলিশকে ধরতে হবে।’’

রাজনীতি সচেতন মানুষজনের একাংশের মতে, বাম আমলে তৃণমূলনেত্রী তাঁর দলের কর্মীদের ‘খুন’ নিয়ে অনেক বড় আন্দোলন করেছিলেন। তা শুনে দিলীপ ঘোষের মন্তব্য, ‘‘পুরুলিয়ায় আমরা টানা সাত দিন ধর্না দিয়েছি। অনেক আন্দোলন করেছি। আর কত করব?’’ তাঁর দাবি, ‘‘আমাদের আন্দোলনের জেরেই পুরুলিয়ায় পুলিশ সুপার থেকে তৃণমূলের ব্লক সভাপতিদের চাকরি গিয়েছে। আগুন না জ্বালালে পছন্দ হয় না কি?’’

যদিও কেন্দায় নিহতদের পরিবার এর সঙ্গে রাজনীতির সম্পর্ক নেই বলেই দাবি করছেন। পুরুলিয়া সদর হাসপাতালের মর্গ থেকে এ দিন নিহতদের দেহ নিয়ে যাওয়ার সময় গাড়িতে লাগানো বিজেপির পতাকা খুলে নেওয়া হয়। কেন খুললেন? নিহতের পরিবারের তরফে নিত্যানন্দ মাহাতো দাবি করেন, ‘‘এই ঘটনার সঙ্গে রাজনীতির কোনও যোগ নেই।’’ নিহতদের বাড়িতে সমবেদনা জানাতে গিয়েছিলেন জেলা তৃণমূল নেতা নবেন্দু মাহালি। সেখানে যান বিজেপির রাজ্য নেতা সুভাষ সরকারও। তিনি হাসপাতালেও নিহত লালমোহনের ছোট ছেলের সঙ্গেও দেখা করেন। সুভাষবাবুর দাবি, ‘‘নিহতেরা যে বিজেপি করতেন, তা না বলার জন্য তাঁদের পরিজনদের উপরে তৃণমূল চাপ সৃষ্টি করছে।’’

কেন্দায় কী থেকে গোলমাল? এক মহিলাকে উত্ত্যক্ত করাকে ঘিরে দুই পরিবারের বিবাদ আগে থেকেই ছিল। দীপক ডেকরেটর্সের ব্যবসা করতেন। বুধবার তিনি বাবার সঙ্গে প্যান্ডেলের মালপত্র রেখে গরুর গাড়ি নিজেরা টেনে বাড়ি ফিরছিলেন। উল্টো দিক থেকে বিরিঞ্চিরা চাষের কাজ সেরে মোষের গাড়ি নিয়ে ফিরছিলেন। অভিযোগ, লালমোহনের গাড়ির চাকার আওয়াজে বিরিঞ্চিদের মোষ লাফালাফি শুরু করে করে। তা নিয়ে দু’পক্ষের মারপিট শুরু হয়ে যায়। বাড়ি থেকেও লোকজন ছুটে আসেন। লাঠি, টাঙ্গি দিয়েও মারধর হয়।

লালমোহনের স্ত্রী পরিবালার অভিযোগ, ‘‘বিরিঞ্চিরা দোকান থেকে অবৈধ ভাবে মদ বিক্রি করে। পুলিশ এক বার হানা দেওয়ায়া ওরা দীপককে সন্দেহ করত। সেই থেকে ওদের সাথে আমাদের বনিবনা নেই।’’ পুরুলিয়া সদর হাসপাতালে ভর্তি থাকা অভিযুক্ত বিরিঞ্চি মাহাতোর বৃদ্ধা মা অঞ্জনা মাহাতো বলেন, ‘‘কী নিয়ে ওদের মধ্যে মারপিট হয়েছিল জানি না। থামাতে গিয়ে আমার হাত ভেঙে গেল।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE