নেপালের খবরেই নজর পরিবারের। —নিজস্ব চিত্র।
ভোটের দিনে পায়ের নীচে মাটিটা কেঁপে উঠতেই পাড়ার অন্যদের মতো তিনিও ভয় পেয়েছিলেন। পরে পাড়ার লোকেদের সঙ্গে তিনিও ভূমিকম্পের অনুভূতি নিয়ে গল্পে মেতেছিলেন। কিন্তু দুপুরে টিভিতে খবরের চ্যানেল খোলার পরই আতঙ্কে তাঁর হাত-পা কাঁপতে শুরু করে। ভূমিকম্পের উৎসস্থল যে নেপাল। সেখানেই যে তাঁর রোজগেরে ছেলেটা কাজে গিয়েছে! বার কতক ছেলেকে ফোনে ধরার চেষ্টা করেও না পেয়ে ভয় আরও জাঁকিয়ে বসেছিল পুরুলিয়ার চূনাভাটি এলাকার প্রৌঢ়া ইসরাজ পরভিনের মনে। বেশ কিছুক্ষণের চেষ্টায় ফোনে পেয়েও কানে যা শুনলেন, তাতে ভয় সরে গিয়ে মন আচ্ছন্ন হল দুশ্চিন্তায়।
কাঁপা কাঁপা গলায় পরভিন বলেন, ‘‘শনিবার একবার মাত্র ছেলেকে ফোনে ধরতে পেরেছিলাম। তখনই ওদের গলা শুনতে পাই। বলছিল অনেক অসুবিধের মধ্যে রয়েছে। খাবার নেই, পানীয় জল নেই। ওরা একটা মাঠের মধ্যে রয়েছে। ওদের জন্য দুয়া করতে বলে। তারপরেই ফোনের লাইনটা কেটে যায়।’’
তারপর মঙ্গলবার পর্যন্ত আরও বেশ কয়েকবার কেঁপে উঠেছে নেপালের মাটি। যতবার টিভিতে ভূমিকম্পের ‘ব্রেকিং নিউজ’ ফুটে উঠেছে, ততবারই আরও বেশি দুশ্চিন্তায় আচ্ছন্ন হয়েছে নেপালে কাজে যাওয়া শ্রমিকদের পরিজনেরা। শুধু এই প্রৌঢ়াই নয়, নেপালে কাজে যাওয়া স্বজনদের খবর পাওয়ার জন্য একই রকম দুশ্চিন্তায় বিনিদ্র রাত কাটাচ্ছে পুরুলিয়া শহরে আরও কয়েকটি পরিবার। এই শহরের জনা দশেক যুবকের সঙ্গে বরাবাজার, পাড়া থানা এলাকার দুবড়ার আরও কয়েকজন যুবক বর্তমানে নেপালে রয়েছেন। স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, মাস ছয়েক ধরে এখানকার জনা পনেরো যুবক বর্তমানে নেপালের নবিসেতে রয়েছেন। এই এলাকার একটি নির্মীয়মান সিমেন্ট কারখানায় তাঁরা কাজ করছেন। ওড়িশার এক ঠিকাদারের মাধ্যমে তাঁরা সেখানে কাজে যান। মাস দুয়েক আগে সেখান থেকে সবাই বাড়িতে কয়েকদিনের জন্য ফেরেন। তারপর ফের নেপালে তাঁরা কাজে গিয়েছেন।
শনিবার নেপালে ভূমিকম্পের জেরে ক্ষয়ক্ষতির খবর জানার পর থেকে পরিবারগুলি অজানা আশঙ্কায় দিন কাটাচ্ছেন। যেমন প্রৌঢ়া ইসরাজ পরভিন বলছেন, ‘‘যতক্ষণ না যোগাযোগ হয়েছে ততক্ষণ যে কী উৎকণ্ঠায় কাটিয়েছি বলে বোঝাতে পারব না। ফোনে ছেলেকে পেয়ে দেখলাম ওরাও খুব ভয়ে রয়েছে। তারপর বারবার যোগাযোগ করার চেষ্টার পরে কখনও মোবাইলে ধরা গিয়েছে, সঙ্গে সঙ্গে লাইন কেটে গিয়েছে। উৎকণ্ঠা তাই কাটছে না। ওদের বাড়ি না ফেরা পর্যন্ত স্বস্তি পাচ্ছি না।’’
আর একটি পরিবারের সদস্য সাগুপ্তা পারভিন বলছিলেন, ‘‘কী ভাবে ওরা রয়েছে বুঝতে পারছি না। জল-খাবার ঠিকমতো পাচ্ছে কি না কে জানে!’’ শেখ আকবরের দুই ছেলে, দুই ভাগ্নে ও এক ভাই রয়েছে নবিসেতে। তিনি বলছিলেন, ‘‘কাঠমান্ডু থেকে নবিসে যেখানে ওরা থাকে, সেখানকার দূরত্ব প্রায় ৩০ কিলোমিটার। কিন্তু কাঠমান্ডুতে যে ফিরে আসবে সে উপায়ও ওদের নেই। ওরা জানিয়েছেস রাস্তা নাকি ফেটে গিয়েছে। শুকনো খাবার যা ছিল তাও শেষ। এমনিতে ওরা ঘুমোতে পারছে না। তাও পালা করে ঘুমোচ্ছে আর রাত জাগছে।’’ তিনি জানান, ওঁদের ফিরিয়ে আনার জন্য তাঁরা এর মধ্যে প্রশাসনের কাছে অনুরোধ জানিয়েছেন। অনেক কষ্টে ফোনে যখনই ওঁদের সঙ্গে পরিবারের লোকেদের যোগাযোগ হচ্ছে, তাঁরা বারবার ফিরিয়ে আনার অনুরোধ জানাচ্ছেন।
তৃণমূলের সংখ্যালঘু সেলের পুরুলিয়া শহর কমিটির সভাপতি মহম্মদ আলমগীর বলেন, ‘‘নেপালে দুর্গতদের উদ্ধারের ব্যাপারে আমরা বিধায়কের মাধ্যমে প্রশাসনের কাছে আবেদন জানিয়েছি।’’ পুরুলিয়ার বিধায়ক কে পি সিংহ দেও জানান, তিনি জেলাশাসককে উদ্ধারের ব্যাপারে অনুরোধ জানিয়েছেন।’’ পুরুলিয়ার জেলাশাসক তন্ময় চক্রবর্তীর আশ্বাস, ‘‘পুরুলিয়া জেলার যাঁরা নেপালে গিয়ে আটকে পড়েছেন তাঁদের সেখান থেকে বাড়ি ফেরানোর চেষ্টা হচ্ছে। বিমানে তাঁদের দিল্লিতে নিয়ে আসা হবে। পরে কলকাতায় ফেরানো হবে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy