Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

আনন্দ ম্লান রাজ্যের ফল দেখে

বীরভূম ও বোলপুর—দুই আসনে জিতেও কেমন যেন মুষড়ে পড়া চেহারা তৃণমূল শিবিরের। সিউড়ি ও বোলপুর শহরে দলীয় প্রার্থীর জয়ের ঘোষণার পরেও না চোখে পড়েছে কর্মী-সমর্থকদের উচ্ছ্বাস, না দেখা গিয়েছে আবির রাঙানো মুখ।

প্রত্যাশী: গণনা তখন প্রায় শেষের মুখে। সিউড়ির ভোটগণনা কেন্দ্রের বাইরে পাশাপাশি বিজেপি প্রার্থী দুধকুমার মণ্ডল, সিপিএমের রেজাউল করিম, কংগ্রেসের ইমাম হোসেন। বৃহস্পতিবার। ছবি: দয়াল সেনগুপ্ত

প্রত্যাশী: গণনা তখন প্রায় শেষের মুখে। সিউড়ির ভোটগণনা কেন্দ্রের বাইরে পাশাপাশি বিজেপি প্রার্থী দুধকুমার মণ্ডল, সিপিএমের রেজাউল করিম, কংগ্রেসের ইমাম হোসেন। বৃহস্পতিবার। ছবি: দয়াল সেনগুপ্ত

বাসুদেব ঘোষ ও পাপাই বাগদি
বোলপুর ও সিউড়ি শেষ আপডেট: ২৪ মে ২০১৯ ০৫:৩৬
Share: Save:

গড় রক্ষা হয়েছে। দু’টি আসনেই জয় এসেছে। একটিতে জয় লক্ষাধিক ভোটের ব্যবধানে। কিন্তু সেই উচ্ছ্বাস কই? বিজয় মিছিল কই? আবিরে পরস্পরকে রাঙিয়ে দেওয়া কই?

বীরভূম ও বোলপুর—দুই আসনে জিতেও কেমন যেন মুষড়ে পড়া চেহারা তৃণমূল শিবিরের। সিউড়ি ও বোলপুর শহরে দলীয় প্রার্থীর জয়ের ঘোষণার পরেও না চোখে পড়েছে কর্মী-সমর্থকদের উচ্ছ্বাস, না দেখা গিয়েছে আবির রাঙানো মুখ। অথচ পঞ্চায়েত থেকে পুরসভা, বিধানসভা থেকে লোকসভা—যে কোনও ভোটেই জেতার পরে ছবিটা গত কয়েক বছরে থেকেছে আলাদা। বিজয় মিছিল থেকে রসগোল্লা বিলি, আবির খেলা থেকে ঢাক পেটানো— ভোটে তৃণমূলের জয়ের পরে এই ধরনের ছবিরই সাক্ষী থেকেছে গোটা জেলা।

সেখানে এ বার দু’টি আসনে জিতেও কেন এমন উল্টো চিত্র?

নাম না প্রকাশ করার শর্তে একাধিক তৃণমূল নেতা বলছেন, ‘‘রাজ্যে আমাদের দলের যা ফল, তাতে এখানে বাড়তি উচ্ছ্বাস দেখানো শোভা পায় না। অন্য কেন্দ্রগুলোতে বিজেপি তো আমাদের ঘাড়ে নিশ্বাস ফেলছে! তাই আর জয়ের আনন্দে উল্লসিত হতে কারও ইচ্ছে হয়নি।’’

যে জেলায় দলের সভাপতি অনুব্রত মণ্ডল, যেখানে প্রার্থীরা নির্বাচনের আগেই জয়ের বিষয়ে নিশ্চিত ছিলেন। ভোট নিয়ে প্রশ্ন উঠলে সগর্বে বলতেন, বিরোধীদের থেকে ব্যবধানের মাত্রা কত বেশি বাড়বে সেটা লক্ষ্য, জয় তো অবধারিত। প্রচারে রোড শো, নাচ, গান, আবির খেলার মতো জমজমাট আয়োজন থাকলেও ফল ঘোষণার দিন সকাল থেকেই দুই কেন্দ্রে জয়ের দিকে এগোনো শাসকদলের দুই প্রার্থীই।

সকালে বোলপুর কলেজে ভোট গণনাকেন্দ্রের আশপাসের এলাকা নিরাপত্তা বলয়ে মোড়া ছিল। বোলপুর হাইস্কুলের কাছ থেকে শ্রীনিকেতন যাওয়ার রাস্তাতে তিনটে ড্রপ গেট দিয়ে যান নিয়ন্ত্রণ করা হয়। কেন্দ্রীয় বাহিনী আর রাজ্য পুলিশের কর্মীরা ছাড়া পথঘাট কার্যত সুনসান ছিল এ দিন সর্বত্রই। বেলা যত গড়িয়েছে তত টিভির পর্দায় বা মোবাইলে বিভিন্ন পোর্টাল বা ওয়েব নিউজের দিকেই চোখ রেখেছেন সকলে। বাদ যাননি প্রার্থীরাও।

সকাল আটটা নাগাদ ভোট গণনা শুরুর প্রথম থেকেই বিজেপি প্রার্থী রামপ্রসাদ দাস এবং সিপিএম প্রার্থী রামচন্দ্র ডোমকে গণনাকেন্দ্রে দেখা গেলেও তৃণমূল প্রার্থী অসিত মাল গণনাকেন্দ্রের ধারেকাছেই যাননি। সকালে কঙ্কালীতলায় পুজো দিয়ে বোলপুরের কাছারি পট্টির বাড়িতে গিয়ে ফের পুজোয় বসেন তিনি। পুজো শেষে শহরের নিচু পট্টিতে দলীয় কার্যালয়ে যান। ভোটের ফল প্রকাশ হওয়া পর্যন্ত কার্যালয়েই ছিলেন তৃণমূল প্রার্থী।

বোলপুরে তৃণমূল প্রার্থী প্রতিটি রাউন্ডেই এগিয়ে ছিলেন। কিন্তু রাজ্য জুড়ে বিভিন্ন কেন্দ্রে তৃণমূলকে পিছনে ফেলে বিজেপি প্রার্থীদের এগিয়ে যাওয়ার ছবিটা বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়তে থাকায় উদ্বেগ বাড়ছিল বীরভূমের তৃণমূল কর্মীদের মধ্যেও। ফলে নিজেদের এলাকায় জয়ের লক্ষ্যে এগনো প্রার্থীর হয়ে আনন্দ উৎসবের আয়োজন হয়নি দিনভর। একমাত্র বোলপুর পুরসভার ৪ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর সুকান্ত হাজরা থালা ভর্তি নকুলদানা বিলি করেন আর কয়েকজন তৃণমূল কর্মীকে সবুজ আবির মাখান। জয়ের পরেও আনন্দে ভাটার কারণ হিসেবে অসিত মালের বক্তব্য, ‘‘৪২টা আসনই প্রত্যাশা ছিল। কিন্তু বিজেপির কোন চালে সিপিএম ও কংগ্রেসের ভোটটাও ওদের দিকে চলে গেল সেটা বুঝলাম না। এই অবস্থায় আনন্দ আয়োজনের মন নেই কারও।’’ বোলপুরের বিজেপি প্রার্থী রামপ্রসাদ দাস অবশ্য গণনাকেন্দ্রে শুরু থেকেই বসে থাকলেও বেলার দিকে ব্যবধান ৮৭ হাজার ছাড়িয়ে যাওয়ার পরে তাঁর প্রতিক্রিয়া, ‘‘আমার এই ফলে আমি খুশি। কারণ দলীয় সংগঠন বলতে তেমন তো কিছু ছিল না।’’

বীরভূম কেন্দ্রের ভোট গণনা হয় সিউড়ি শ্রীরামকৃষ্ণ শিল্প বিদ্যাপীঠে। শহরের যান চলাচল নিয়ন্ত্রণ করা হয় সকাল থেকে। গণনাকেন্দ্রের ১০০ মিটার দূরত্বে সিপিএম ও বিজেপির ক্যাম্প থাকলেও তৃণমূলের কোনও ক্যাম্প নজরে পড়েনি। অন্যবার শাসক দলের পক্ষ থেকে খাওয়াদাওয়ার আয়োজন করা হলেও এবার তা হয়নি। বিজেপির পক্ষ থেকে অবশ্য টিফিনের ব্যবস্থা করা হয়েছিল।

সকাল সওয়া ছটা নাগাদ তৃণমূল প্রার্থী শতাব্দী রায় গণনাকেন্দ্রে পৌঁছন। বেশ গণনা শুরু হওয়ার পরে বেরিয়ে যান। কিছুক্ষণ পরেই যান বিজেপি প্রার্থী দুধকুমার মণ্ডল। প্রায় ঘন্টা খানেক পরে পৌঁছন বাম প্রার্থী রেজাউল করিম। তার পরেই আসেন কংগ্রেস প্রার্থী ইমাম হোসেন। ওই তিন জনকে নিজেদের মধ্যে খোশগল্প করতে যায়।

প্রথম রাউন্ড থেকেই তৃণমূল এগিয়ে থাকলেও বিজেপি খুব পিছিয়ে ছিল না। কিন্তু, পঞ্চম রাউন্ডের শেষে শতাব্দীর ব্যবধান অনেকটাই বেড়ে হয় ৩৮ হাজারেরও বেশি। পরের রাউন্ড থেকে ব্যবধান কমতে শুরু করে। একটা সময় ২৩ হাজারে নেমে যায়। শোনা যাচ্ছিল, সেটা ১২-১৩ হাজার হয়ে গিয়েছে। তখন উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়ে তৃণমূল শিবিরে। পরে জানা যায়, ভুল খবর। স্বস্তি ফেরে তৃণমূলে।

দলীয় কার্যালয়ে জেলা সভাপতির পাশে বসে উদ্বিগ্ন শতাব্দী প্রতি রাউন্ডের পুঙ্খানুপুঙ্খ খোঁজ নিতে থাকেন। ১৩ রাউন্ডের পর জয় নিশ্চিত হওয়ায় হাসি ফোটে তাঁর মুখে। তাও কেন আবির খেলা বা শোভাযাত্রা হল না? জেলা সভাপতি অনুব্রত মণ্ডলের দাবি, ‘‘কোনওবারই তো জিতে আসার পরে উচ্ছ্বাস, উল্লাস হয় না। মিছিল করি না। এ বারও করিনি। বাকিটা রাজ্য নেতৃত্ব বলবেন।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Election Results 2019 TMC Bolpur
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE