Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

গরমে ধুঁকছে পেঁচা-সাপ, কপালে ভাঁজ দীনবন্ধুদের

তীব্র তাপপ্রবাহে প্রাণ ওষ্ঠাগত। সূর্যের তেজ উপেক্ষা করে সাধ্যি কার। কিন্তু, প্রখর দাবদহে কষ্ট কি কেবল মানুষেরই? পশু, পাখি, সরীসৃপ— এদের কষ্ট হয় না? ‘‘কষ্ট সকলেরই। আমরা নিজেদের নিয়েই এত ব্যস্ত, বাকিদের কথা ভাবছে কত জন,’’— বলছেন প্রকৃতিপ্রেমীরা।

গরমে গাছ থেকে পড়ে যাওয়া এক পেঁচার ছানার পরিচর্যায় ব্যস্ত দীনবন্ধুবাবু ও গরমে অসুস্থ জোড়া পেঁচা।।—নিজস্ব চিত্র

গরমে গাছ থেকে পড়ে যাওয়া এক পেঁচার ছানার পরিচর্যায় ব্যস্ত দীনবন্ধুবাবু ও গরমে অসুস্থ জোড়া পেঁচা।।—নিজস্ব চিত্র

দয়াল সেনগুপ্ত
সিউড়ি শেষ আপডেট: ২৬ এপ্রিল ২০১৬ ০১:৫৮
Share: Save:

তীব্র তাপপ্রবাহে প্রাণ ওষ্ঠাগত। সূর্যের তেজ উপেক্ষা করে সাধ্যি কার। কিন্তু, প্রখর দাবদহে কষ্ট কি কেবল মানুষেরই? পশু, পাখি, সরীসৃপ— এদের কষ্ট হয় না? ‘‘কষ্ট সকলেরই। আমরা নিজেদের নিয়েই এত ব্যস্ত, বাকিদের কথা ভাবছে কত জন,’’— বলছেন প্রকৃতিপ্রেমীরা।

সিউড়ি অজয়পুর হাইস্কুলের শিক্ষক দীনবন্ধু বিশ্বাস অবশ্য উদাসীনদের দলে পড়েন না। তাঁর অভিজ্ঞতা বলছে, প্রখর তাপে এবং তীব্র জলকষ্টের জন্য অসুস্থ হয়ে পড়ছে পাখি, পশু, সরীসৃপ সবাই-ই।

দু’দিন আগের কথা। স্কুল চত্বরে একটি কুটুরে পেঁচার ছানা পড়ে থাকতে দেখে দীনবন্ধুবাবুকে খবর দেন সহ-শিক্ষিকারা। গরমে অসুস্থ পেঁচাটিকে উদ্ধার করে আনেন ওই শিক্ষক। এখন পেঁচাটি অনেক সুস্থ। শুধু ওই পেঁচাটিই নয়, সিউড়ির গাংটে গ্রামের পুকুরপাড়ে একটি গাছ থেকে আরও পাঁচটি কুটুরে পেঁচার ছানা পড়ে যাওয়ার পরে সেগুলির স্থান হয়েছে ওই শিক্ষকের বাড়িতেই। যদিও জলে পড়ে যাওয়ায় একটি পেঁচাকে বাঁচানো যায়নি। কিন্তু, বাকিগুলিকে স্যালাইন ওয়াটার ও মুরগির মাংসের টুকরো খাইয়ে বেশ খানিকটা চাঙা করে ফেলেছেন ওই শিক্ষক। শুধু পেঁচার বাচ্চাই নয়, তিলপাড়া জলাধারের কাছের পড়ে থাকা একটি অসুস্থ বোঁড়াচিতি সাপ ও অন্যগ্রাম থেকে একটি গোসাপেরও স্থান হয়েছে দীনবন্ধুবাবুর বাড়িতে। অসুস্থতার কারণ অবশ্যই প্রখর তাপ। বোঁড়াচিতি সাপটির পেটে ডিম রয়েছে। সেবা শুশ্রূষার পরে দু’টি সরীসৃপই আপাত সুস্থ। তবে বন দফতরের অনুমতি নিয়ে চিতি সাপটির বাচ্চা হওয়া পর্যন্ত নিজের বাড়িতেই রাখতে চান তিনি।

ভারত সরকারের ‘ওয়াইল্ড লাইফ ক্রাইম কন্ট্রোল ব্যুরো’র স্বেচ্ছাসেবী সদস্য দীনবন্ধুবাবু বলছেন, ‘‘চারদিকে জলাশয় শুকিয়ে যাচ্ছে। এই গরমে প্রচণ্ড জলকষ্ট দেখা দিয়েছে। বেশ কিছু এলাকায় গাছ না থাকায় সমস্যা আরও বাড়ে। এতেই অসুস্থ হয়ে পড়ছে পশুপাখি। অথচ আমরা যদি সামান্য একটু সহযোগিতার হাত বাড়াই তা হলে ওরা প্রাণে বাঁচতে পারে।’’ দীনবন্ধুবাবুর পরামর্শ, যদি প্রতি পরিবার দু’তিনটি মাটির পাত্রে একটু করে জল রাখা হয়, তাতেই অনেক সমস্যা মেটে। একই দাবি জানিয়েছেন, বোলপুরের আর এক প্রকৃতিপ্রেমী তথা বন দফতরের ওয়ার্ডেন ঊর্মিলা গঙ্গোপাধ্যায়। তাঁর মতে।, এ ব্যাপারে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়া, স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সদস্য, প্রত্যেকেরই এগিয়ে আসা উচিত। ‘‘যদি গ্রীষ্মের এই সময়টায় বাড়িতে বাড়িতে পাত্রে একটু করে জল রাখা যায়, তা হলে পাখি, কাঠবিড়ালি, গিরগিটি, পিঁপড়ে সকলেই তৃষ্ণার জল পেতে পারে,’’—বলছেন ঊর্মিলাদেবী।


তিলপাড়া জলাধার ও ময়ূরাক্ষী ক্যানাল এলাকা থেকে উদ্ধার হওয়া সাপ ও গোসাপ।

এ দিকে পক্ষী বিশেষজ্ঞেরা জানাচ্ছেন, বসন্তকালে অনেক পাখির প্রজননের সময়। পেঁচার মতো কিছু প্রজাতি আছে, যারা এই সময়ে গাছের ফোঁকরে ডিম পেড়ে বাচ্চার জন্ম দেয়। কিন্তু, এ বার এত তাড়াতাড়ি তাপমাত্রা বেড়ে গিয়েছে যে বাচ্চাগুলি তাপ সহ্য করতে পারছে না। পেঁচাদের অন্য একটি সমস্যা, দিনের আলোয় বাইরে এলেই কাকের আক্রমণ। এতটা তাপে জল ছাড়া থাকতে অসুবিধা হচ্ছে বাচ্চাগুলোর। বাদুর স্তন্যপায়ী হলেও এদের ক্ষেত্রেও প্রায় এ রকই সমস্যা। সারাদিন সূর্যের তাপে ঝুলে থাকতে থাকতে মারা যেতে পারে। অন্য পাখিদেরও তাপের জন্য সমস্যা হচ্ছে। এ দিন দুপুরেই তার প্রমাণ মিলল। সিউড়ির ওই শিক্ষকের কাছে এক পরিচিত একটি বন টিয়াপাখির অসুস্থ বাচ্চাকে পৌঁছে দিয়ে গেলেন।

ঘটনা হল, বছর তিনেক আগে ২০১৩ সালে এমনই একটি উদ্যোগ নেন বীরভূমের তৎকালীন ডিভিশনাল ফরেস্ট অভিসার কিশোর মাঁকড়। হাজারখানেক মাটির পাত্র জেলার আটটি রেঞ্জ অফিসে ও ২০টি বিট অফিসে বিলি করার জন্য পৌঁছে দিয়েছিলেন। সেই সঙ্গে সিউড়ির চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণির ২০০ জন স্কুলপড়ুয়ার মধ্যেও বিলি করা হয়েছিল ওই মাটির পাত্র। লক্ষ্য একটাই— প্রাকৃতিক ভারসাম্য বজায় রাখার অন্যতম অঙ্গ পশুপাখিরা যেন গ্রীষ্মকালে জলের অভাবে মারা না যায়, তার ব্যবস্থা করা। সেই সচেতনতা ছোটদের মধ্যেও ছড়িয়ে দেওয়া। কিশোরবাবুর বক্তব্য ছিল, “২০১০ সাল থেকেই লক্ষ্য করছি আশপাশের বেশ কিছু পাখি গ্রীষ্মকালে মরে যাচ্ছে। কারণ খুঁজতে গিয়ে বুঝতে পারি, প্রধানত জলাভাবেই মৃত্যু হয়েছে তাদের। সেই জন্য ওই ব্যবস্থা।”

সেই ব্যবস্থার এখন কী হাল? জেলার বর্তমান ডিভিশনাল ফরেস্ট অভিসার কল্যাণ রায় বলছেন, ‘‘এখনও সেই ব্যবস্থা চালু রয়েছে। এ ছাড়া বনসুরক্ষা কমিটির সদস্যদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার সময়ে এ ব্যাপারে সচেতন করা হয়। সাধারণ মানুষকে সচেতন করার জন্য শীঘ্রই বোলপুরে একটি ওয়ার্কশপ করার ভাবনাও রয়েছে।’’ দীনবন্ধুবাবুর উদ্যোগকেও স্বাগত জানিয়েছেন ডিএফও।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Snake Owl Heat
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE