Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪

অসহায় মহিলাদের পাশে লাভপুরের কেন্দ্র

আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধানের পথ খুঁজে ফের জীবনে শান্তিতে বাঁচার দিশা পেয়েছেন তাঁরা।

দিশা: সংস্থার কার্যালয়ে চলছে কাউন্সেলিং। নিজস্ব চিত্র

দিশা: সংস্থার কার্যালয়ে চলছে কাউন্সেলিং। নিজস্ব চিত্র

নিজস্ব সংবাদদাতা
লাভপুর শেষ আপডেট: ১১ জুলাই ২০১৮ ০৭:২০
Share: Save:

শ্বশুরবাড়ির অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে কেউ ঠাঁই নিয়েছিলেন বাপেরবাড়ি। কেউ আবার আত্মহত্যার চেষ্টাও করেন। কেউ ছেলের কাছে ভাত না পেয়ে পথে পথে ভিক্ষা করতে বাধ্য হয়েছিলেন— অসহায় এমনই মহিলাদের পাশে দাঁড়াল লাভপুরের কাউন্সেলিং সেন্টার। আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধানের পথ খুঁজে ফের জীবনে শান্তিতে বাঁচার দিশা পেয়েছেন তাঁরা।

প্রশাসন ও স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, বছরখানেক আগে বীরভূম জেলা পুলিশ, বীরভূম সংস্কৃতি বাহিনীর যৌথ উদ্যোগ এবং শান্তিনিকেতনের এলমহার্স্ট ইনস্টিটিউট ও লাভপুর থানার সাহায্যে লাভপুরে বীরভূম সংস্কৃতি বাহিনীর কার্যালয়ে ওই কেন্দ্র চালু করা হয়। সেখানেই প্রতি মাসের দ্বিতীয় শনিবার হয় কাউন্সেলিং। পুলিশ আধিকারিক, মনোবিদ, সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রের মানুষ আলোচনার মাধ্যমে দীর্ঘ দিনের সমস্যার জট খুলে মূলস্রোতে ফিরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন অসহায় মহিলাদের। ওই কেন্দ্র সূত্রে খবর, ইতিমধ্যেই

প্রায় ১৫০টি পরিবারের সঙ্গে বৈঠক হয়েছে। বেশির ভাগই দাম্পত্য কলহ বা শাশুড়ি-পুত্রবধূর বিবাদ। তার মধ্যে ৪০টি পরিবার খুঁজে পেয়েছে সমাধানের পথ।

তাতেই হাসি ফুটেছে মণি রজক, দীপা বিবি, সোহাগবালা দাসীদের (নাম পরিবর্তিত)। ওই কেন্দ্র সূত্রে জানা গিয়েছে, লাভপুরের প্রত্যন্ত গ্রামের মণি রজকের স্বামীর অন্য মহিলার প্রতি আসক্তি ছিল। বাড়ির দিকে নজর ছিল না। দু’বেলা দু’মুঠো ভাতের সংস্থান করা দূর, বৃষ্টির দিনে ছেলেমেয়েদের নিয়ে দুর্ভোগ পোহাতে হত মণিদেবীকে। কারণ সংস্কারের অভাবে ভেঙে পড়ত বাড়ির চাল। বার বার বলেও নজর ফেরেনি তাঁর স্বামীর। কিছু বলতে গেলেই জুটত মার। ক্ষোভে-দুঃখে গায়ে কেরোসিন ঢেলে আত্মহত্যা করতে গিয়েছিলেন ওই মহিলা।

সেটা প্রায় আট মাস আগের কথা। এখন স্বামী-ছেলেমেয়েকে নিয়ে মণিদেবীর সুখের সংসার। বাড়ির চালে নতুন টিনের চালা। অন্য নারীর উপরে স্বামীর আসক্তিও মিটেছে। তাঁর দিনমজুরির আয়ে এখন সংসারে ফিরেছে স্বস্তি।

কী করে সম্ভব হল?

পারিবারিক সূত্রে জানা গিয়েছে, মণিদেবী আত্মহত্যার চেষ্টা করেছেন, সে কথা জেনেছিলেন তাঁর ভাসুর। তিনিই তাঁকে বাঁচান। তারপর দু’পক্ষকে নিয়ে কাউন্সেলিং সেন্টার হাজির করেন। পাঁচ বার কাউন্সেলিং করা হয়। শেষ বার অবশ্য আর ভাসুরকে আসতে হয়নি। স্ত্রীকে নিয়ে একসঙ্গে বাড়ি ফিরেছিলেন স্বামী। সেই কথা বলতে গিয়েই একমুখ হাসি দুই সন্তানের মা মণিদেবীর। তিনি বলেন, ‘‘বাঁচার আশা ছেড়েই দিয়েছিলাম। কাউন্সেলিং সেন্টার ফের নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখিয়েছে।’’ তার স্বামী বলেন, ‘‘এত দিন আমি যে ভুল পথে চলছিলাম তা ওই কেন্দ্রই বুঝিয়েছে।’’ একই প্রতিক্রিয়া দীপা বিবি, সোহাগবালা দাসীরও।

লাভপুর থানা এলাকারই বাসিন্দা দীপা বিবি। তাঁর স্বামী দিল্লিতে রাজমিস্ত্রির কাজ করেন। বাড়ি আসেন কালেভদ্রে। সংসারের জন্য কোনও টাকাপয়সা দেন না। বাধ্য হয়ে দুই ছেলেমেয়েকে নিয়ে বাপের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলেন দীপা বিবি। স্বামীর বিরুদ্ধে বধূ নির্যাতন ও খোরপোষের মামলা করেন। কিন্তু তাতে দু’পক্ষই হয়রান হয়ে পড়েছিলেন। শেষে দুই পরিবারের ঘনিষ্ঠ এক বন্ধু তাঁদের কাউন্সেলিং সেন্টারে নিয়ে যান। ছ’বারের কাউন্সেলিংয়ের পরে মেলে সমাধানসুত্র। দীপা বিবিকে বাড়িতে ফিরিয়ে এনেছেন তাঁর স্বামী। দিল্লির বদলে এখন লাভপুরের আশপাশেই কাজ করেন তিনি।

সোহাগবালার দুই ছেলের কেউই মাকে দু’বেলা দু’মুঠো ভাত দিত না। অন্যের অনুগ্রহে দিন কাটত তাঁর। কাউন্সেলিং-এর পরে হাসি ফুটেছে তাঁর মুখেও। বড় ছেলের বাড়িতে নাতিনাতনিদের সঙ্গে আনন্দে দিন কাটছে। তাঁর ছেলে বলেন, ‘‘ভুল ভেঙেছে। আর মায়ের

অমর্যাদা করব না।’’

এ সবে খুশি দীপা বিবি আর সোহাগবালারা। তাঁরা জানান, এ ভাবে আলোচনায় যে এত সহজে সমস্যার সমাধান হতে পারে তা ভাবতেও পারেননি।

কাউন্সিলিং সেন্টারের দায়িত্বপ্রাপ্ত মনোবিদ এলমহার্স্টের সুস্মিতা বসু ও সোনিয়া ঘোষ জানান, অনেক সময় সামান্য ভুল বোঝাবুঝি বিরাট আকার নিতে পারে। প্রথম দিকে দু’পক্ষই ভুল শুধরে কাছাকাছি ফিরতে চান। চান কেউ এক জন মধ্যস্থতা করে তাঁদের ভুল বোঝাবুঝি মিটিয়ে দিক। কিন্তু মধ্যস্থতার পরিবর্তে অনেকে ক্ষেত্রে ঝামেলায় ইন্ধন জোগানোর ঘটনা ঘটে। তাই সংসার ভাঙতে বসে। আলোচনার মাধ্যমে সেই ভাঙন রোখার চেষ্টা করা হয়।

বীরভূম সংস্কৃতি বাহিনীর তরফে উজ্জ্বল মুখোপাধ্যায় জানান, কাউন্সিলিং সেণ্টারে সমাধান খুঁজে পাওয়া মহিলারা এখন তাঁদের মতোই সমস্যায় থাকা মহিলাদের ওই কেন্দ্রে নিয়ে আসছেন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Woman Helpless women
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE