Advertisement
২৩ এপ্রিল ২০২৪

ধর্ষণের মিথ্যা মামলায় জেল, কে ফেরাবে সেই চারটে বছর?

অভিযোগকারিণীর সঙ্গে চেষ্টা করেও যোগাযোগ করা যায়নি। তবে মামলার সরকার পক্ষের আইনজীবী অমিয় চক্রবর্তী বলেছেন, “নিম্ন আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে আমরা উচ্চ আদালতে যাব।”

নিজস্ব সংবাদদাতা
বাঁকুড়া শেষ আপডেট: ০৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ ০০:৪৮
Share: Save:

ধর্ষণের অভিযোগে গ্রেফতারের পরে মুক্তি পাননি এক দিনও। জেলের কুঠুরিতেই দিন কেটেছে তাঁর। লোকজনের গঞ্জনায় আর অনটনে স্বামীর ঘর ছেড়ে দুই ছেলেকে নিয়ে বাপের বাড়িতে উঠে যেতে হয়েছিল স্ত্রীকে। কিন্তু স্বামীর উপরে বিশ্বাস হারাননি। ভরসা রেখেছিলেন আইনের উপরেও। শেষ পর্যন্ত বৃহস্পতিবার মামলা থেকে বেকসুর খালাস পেলেন বাঁকুড়ার সদর থানার বনকাটির বেলডাংরা গ্রামের সেই সুজয় ভুঁই। কিন্তু তত দিনে পার হয়ে গিয়েছে চার-চারটে বছর। তাই মুক্তির স্বস্তি পেয়েও তিনি প্রশ্ন তুলেছেন— ‘‘মিথ্যা মামলায় জেল খাটতে হল। কে ফিরিয়ে দেবে আমার চারটে বছর?’’

এ দিন বাঁকুড়া আদালতের অতিরিক্ত জেলা দায়রা বিচারক (১) মনোজ্যোতি ভট্টাচার্যের এজলাসে ওই রায় দান হয়। রায় শুনেই আদালতে কেঁদে ফেলেন সুজয়ের স্ত্রী শ্রাবণী ও তাঁর বড় ছেলে বছর দশেকের আকাশ ও তাঁদের পরিজনেরা। তাঁরা অপেক্ষা করতে থাকেন কখন জেল থেকে ছাড়া হবে সুজয়বাবুকে। জেল থেকে বাবাকে বেরিয়ে আসতে দেখেই দৌড়ে গিয়ে তাঁকে জড়িয়ে ধরে আকাশ। সে বলে, “বাবাকে দেখতে জেলে আসতাম। ফিরে যাওয়ার সময় মা প্রতিবার বলত, এক দিন বাবা বাড়িতে ফিরে আসবেই। আজ মায়ের কথাই সত্যি হল।”

সুজয়বাবুর আইনজীবী সায়ন্তন চৌধুরীর দাবি, “এফআইআর-এ উল্লেখ করা ঘটনার সঙ্গে অভিযোগকারিণীর জবানবন্দি ও ডাক্তারি রিপোর্টের সামঞ্জস্য ছিল না। সাক্ষ্য-প্রমাণ সহ সব দিক খতিয়ে দেখেই আদালত সুজয়বাবুকে বেকসুর খালাস দিয়েছেন।”

অভিযোগকারিণীর সঙ্গে চেষ্টা করেও যোগাযোগ করা যায়নি। তবে মামলার সরকার পক্ষের আইনজীবী অমিয় চক্রবর্তী বলেছেন, “নিম্ন আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে আমরা উচ্চ আদালতে যাব।”

সুজয়বাবুর আইনজীবী জানিয়েছেন, পেশায় কাঠমিস্ত্রি সুজয়বাবুর বিরুদ্ধে তাঁর এক আত্মীয়া কাজের টোপ দিয়ে বেলিয়াতোড়ের জঙ্গলে নিয়ে গিয়ে ধর্ষণ করার অভিযোগ দায়ের করেছিলেন। ২০১৪ সালের ২২ জানুয়ারির ঘটনা। দু’দিন পরে ওই যুবতী থানায় অভিযোগ দায়ের করার পরেই পুলিশ সুজয়বাবুকে গ্রেফতার করেছিল। এক মাসের মাথায় পুলিশ তাঁর বিরুদ্ধে আদালতে চার্জশিট জমা করে। আর জামিন পাননি তিনি। বিচারাধীন বন্দি হিসেবে বাঁকুড়া সংশোধনাগারই ছিল তাঁর ঠিকানা।

তিনি যখন বন্দিজীবন কাটাচ্ছেন, তখন তাঁর পরিবারও চরম অনটনের শিকার হন। শ্রাবণীর কথায়, ‘‘স্বামীকে যখন পুলিশ ধরে নিয়ে গেল, তখন ছোট ছেলে নীলের বয়স এক বছর। বড় ছেলেকে সবে স্কুলে ভর্তি করেছি। সংসারের একমাত্র রোজগেরে মানুষ জেলে যাওয়ায় প্রবল দারিদ্রের মধ্যে পড়ে যাই। সেই সঙ্গে বাইরে বের হলেই লোকজনের গঞ্জনা শুনতে হচ্ছিল। তাই বাধ্য হয়ে দুই ছেলেকে নিয়ে বাপেরবাড়ি ওন্দায় চলে যাই।’’

কিন্তু অত বড় অভিযোগের পরেও স্বামীকে অবিশ্বাস করেননি তিনি। তিনি বলে চলেন, ‘‘আমার স্বামী যে নির্দোষ, সেই বিশ্বাস ছিল প্রথম থেকেই। তাই নিয়ম করে জেলে এসে ওর সঙ্গে দেখা করে যেতাম। এক বারের জন্যও আমরা হাল ছাড়িনি।” আইনি লড়াইয়ে তিনি পাশে পেয়েছেন তাঁর বাবাকে। টিউশন পড়ানোর সামান্য আয় থেকে সংসার সামলে তিনি জামাইয়ের আইনি লড়াইয়ের খরচ জুগিয়েছেন। শ্রাবণীকে সাহস দিয়েছেন তাঁর শ্বশুর-শাশুড়ি।

জেল থেকে বেরিয়ে সুজয়বাবু বলেন, “মিথ্যা অভিযোগে ফাঁসানো হয়েছিল। আদালতের রায়ে এতদিনে তা প্রমাণিত হল।’’ কিন্তু আক্ষেপ ঘুচছে না তাঁর। বারবার বলছিলেন, ‘‘ছোট ছেলেটাকে কত দিন চোখেই দেখিনি। সে কি আমায় এতদিন পরে চিনতে পারবে? বড় ছেলেটা কী ভাবে এত বড় হয়ে উঠল, সে সবও দেখতে পেলাম না। চারটে বছর আমার জীবন থেকে কত কিছু কেড়ে নিয়েছে।’’

আইনজীবীরা জানাচ্ছেন, সুজয়বাবুর বিরুদ্ধে যে মামলা রুজু হয়েছিল, তাতে ন্যূনতম সাত বছর ও সর্বোচ্চ যাবজ্জীবন সাজা হতে পারত। তার মধ্যে বিচারাধীন অবস্থাতেই চার বছর জেল খাটতে হল সুজয়বাবুকে। বিচার পেতে এতদিন সময় লাগল কেন, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন অনেকে।

অনেকে আবার পুলিশের তদন্ত নিয়েও সমালোচনা শুরু করেছেন। জেলা পুলিশের এক কর্তা বলেন, ‘‘আদালতের নির্দেশ না পেলে কিছু বলা যাবে না।’’

সুজয়বাবু অবশ্য আর ওসব নিয়ে ভাবতে চান না। ছেলে, স্ত্রীকে পাশে নিয়ে যেতে যেতে তিনি বললেন— ‘‘পরিবারের সঙ্গে এখন শান্তিতে থাকতে চাই।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Jail Rape
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE