Advertisement
১৮ এপ্রিল ২০২৪

বাতিল নোটেই মজুরি, মন্দ কপাল শ্রমিকদের

দিন দুয়েক আগে সারা মাসের মজুরি পেয়েছেন দীপক এবং বাল্মীকি। পুরোটাই অচল পাঁচশো আর হাজার টাকার নোটে। পারবেলিয়ার বাসিন্দা দীপক অগ্রবাল এবং বাল্মীকি রবিদাস নিতুড়িয়ার একটি স্পঞ্জ আয়রন কারখানায় শ্রমিকের কাজ করেন।

নিজস্ব প্রতিবেদন
শেষ আপডেট: ২১ নভেম্বর ২০১৬ ০১:১০
Share: Save:

দিন দুয়েক আগে সারা মাসের মজুরি পেয়েছেন দীপক এবং বাল্মীকি। পুরোটাই অচল পাঁচশো আর হাজার টাকার নোটে। পারবেলিয়ার বাসিন্দা দীপক অগ্রবাল এবং বাল্মীকি রবিদাস নিতুড়িয়ার একটি স্পঞ্জ আয়রন কারখানায় শ্রমিকের কাজ করেন। কর্তৃপক্ষ বলেছে, খুচরো নেই। অচল নোটে না নিলে আপাতত মাইনেই মিলবে না। নেই মামার চেয়ে কানা মামা ভাল ভেবে তাঁরা সেই টাকা নিয়েছিলেন। কিন্তু এখন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন, অচল টাকা নেই মামারই সামিল। বরং এর তুলনাটা হতে পারে দুষ্টু গরুর সঙ্গে। ব্যাঙ্কে ছোটাছুটি করতে গিয়ে এখন কাজ কামাই হচ্ছে তাঁদের।

পাঁচশো আর হাজার টাকার সমস্ত পুরনো নোট বাতিলের পরে মুশকিলে পড়েছেন শ্রমিকেরা। কারখানার শ্রমিক, রাজমিস্ত্রি, কলের মিস্ত্রি— এক এক জনের সমস্যা এক এক রকমের। তাঁদের অনেকেরই দাবি, মজুরি বাবদ পাওয়া একটা বড় নোট ভাঙিয়ে সংসার চলে এসেছে এত দিন। কারও সংসার চলেছে দিন আনা টাকায়। সেই সমস্ত নোট বাতিলের ধাক্কায় তাঁদের সংসার চালানোই দায় হয়ে পড়েছে। কারও অচল নোটে মাইনে হচ্ছে, কারও সেটুকুও জুটছে না। ডিভিসিতে ঠিকা শ্রমিক হিসাবে কাজ করেন নিত্যানন্দ মণ্ডল। তিনি বলেন, ‘‘এমনিতেই সময়ে মজুরি পেতাম না। তার উপরে নোট বাতিলের পরে পাকা দেড় সপ্তাহ কোনও টাকাই পাচ্ছি না। ঠিকাদার বলছে খুচরো নেই।’’

বস্তুত, রাতারাতি পাঁচশো ও হাজার টাকার পুরনো নোট বাতিল হয়ে যাওয়ার পরে সিঁদুরে মেঘ দেখেছিলেন শ্রমিক এবং ঠিকাদারদের একাংশ। রঘুনাথপুরে তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রটি রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা ডিভিসি-র। সেখানে দুই ধরনের ঠিকা শ্রমিক বর্তমানে কাজ করেন। কিছু শ্রমিকের সারা মাসের মজুরি তাঁদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে জমা করে দেয় ঠিকাদার সংস্থা। কেউ দিনের মজুরি হাতে হাতে পান। তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র সূত্রে জানা গিয়েছে, এমন শ্রমিকের সংখ্যা অন্তত পাঁচশো। সমস্যা বেশি হচ্ছে তাঁদেরই। ঠিকা শ্রমিক নিত্যানন্দবাবুর দাবি, কাজ ফেলে ব্যাঙ্কে লাইন দিতে না পারায় কাছে থাকা বড় নোট এখনও ভাঙাতে পারেননি। এ দিকে হাতে যা খুচরো টাকা ছিল তা ফুরোতে বসেছে। এই পরিস্থিতিতে সংসার চালানো দুষ্কর হয়ে পড়ছে।

সমস্যায় পড়েছেন ঠিকাদারদের একাংশ। তাঁরা জানান, শ্রমিকেরা কেউই অচল টাকা নিচ্ছেন না। এ দিকে ব্যাঙ্ক থেকে পর্যাপ্ত একশো টাকার নোট মিলছে না। ফলে মজুরি দিতে সমস্যা হচ্ছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ঠিকাদার বলেন, ‘‘একশো জন শ্রমিককে দৈনিক মজুরি দিতে কুড়ি হাজার টাকা লাগে। এত দিন যা টাকা জমা ছিল তা দিয়ে মজুরি দিয়েছি। কিন্তু সেটাও ফুরিয়ে এসেছে। এ বারে কী ভাবে চলবে বুঝে উঠতে পারছি না।’’ তিনি জানান, এক কর্মীকে টাকা তুলে আনতে ব্যাঙ্কে পাঠিয়েছিলেন। দীর্ঘক্ষণ লাইন দিয়ে তিনি ফিরেছেন মাত্র দশ হাজার টাকা নিয়ে। তার মধ্যেও আবার বেশ কিছু দু’ হাজার টাকার নোট ছিল। তাঁর মতে, ব্যাঙ্ক দু’হাজার টাকার নোট দেওয়া শুরু হওয়ায় মজুরি দেওয়ার ক্ষেত্রে সমস্যা হচ্ছে। ওই ঠিকাদারের দাবি, দু’হাজার টাকার নোটের ভাঙানি পেতে তাঁদের খুবই সমস্যা হচ্ছে।

মজুরি দেওয়ার খুচরো নেই বলে থমকে গিয়েছে অনেক গৃহস্থের বাড়ি তৈরি বা মেরামতির কাজ। সমস্যায় পড়েছেন রাজমিস্ত্রিরা। জলের কল সারাইয়ের মিস্ত্রিদেরও আগের মতো ডাক পড়ছে না আর। পুরুলিয়া শহরের ট্যাক্সিস্ট্যান্ড ও চকবাজার এলাকায় প্রতিদিন সকালে কাজের আশায় জড়ো হন অনেক রাজমিস্ত্রি ও কলের মিস্ত্রি। আশপাশের বিভিন্ন গ্রাম থেকে আসেন তাঁরা। রাজমিস্ত্রি আষাড়ি কুমার, গৌতম লায়া, ধর্মদাস পরামানিক এবং কলের মিস্ত্রি তাহির আনসারিরা জানান, কোনও বাড়িতে ছোটখাটো মেরামতির কাজ দৈনিক মজুরির কড়ারে করে থাকেন তাঁরা। গত এক সপ্তাহ ধরে বিশেষ কাজ মিলছে না। তাঁরা বলেন, ‘‘দুশো বা আড়াইশো টাকার চুক্তিতে কাজ করি। সবাই পাঁচশো টাকার নোট দেবে বলছে। বাধ্য হয়ে সমস্ত জেনেশুনেই ওই নোট নিতে হচ্ছে।’’

বাঁকুড়ার জয়পুরের একটি নামজাদা রিসর্টের কর্মীরাও বেতন না পেয়ে সমস্যায় পড়েছেন। ওই রিসর্টে কমপক্ষে একশো জন শ্রমিক সাপ্তাহিক বেতনের চুক্তিতে কাজ করেন। এই সপ্তাহে বেতন জোটেনি তাঁদের। রিসর্টের কর্মী মাকু সরেন, সন্ধ্যা লোহাররা বলেন, “মালিক বাতিল নোটে বেতন দিতে চাইছেন। কিন্তু নিলে তো ভাঙাতে পারব না। এক বেলা উপোস করে দিন কাটছে।’’ রিসর্টের মালিক মহাদেব মণ্ডল বলেন, “ব্যাঙ্কে গিয়ে টাকা তুলতে পারছি না। ব্যবসার সমস্ত লেনদেন কার্ড আর চেকে মেটাচ্ছি। কর্মীদের সমস্যাটা বুঝছি। কিন্তু আমিও তো নিরুপায়!”

বাঁকুড়া জেলা মুটিয়া মজদুর ইউনিয়নের সম্পাদক তপন দাস জানান, জেলার প্রায় কোথাওই মুটিয়া মজদুরেরা মজুরি পাচ্ছেন না। বাঁকুড়ার বিবেকানন্দপল্লির বাসিন্দা সোহরাব মণ্ডল শহরের একটি সিমেন্টের গুদামে মুটিয়া শ্রমিকের কাজ করেন। তাঁর কথায়, “নোট বাতিলের পরে খুব টানাটানি চলছে। মুদির দোকান, সব্জির দোকানে ধার। সবাই তাড়া দিচ্ছে। কিন্তু মজুরি না পেলে আমি কী করে মেটাবো?’’

তবে হয়রানির মধ্যেও মুচকি হাসি খেলে যাচ্ছে অনেকের মুখে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক তেমনই এক শ্রমিক বলেন, ‘‘কালো টাকা কাকে বলে জানি না, তবে ঘুষের টাকা তো জানি। অসৎ উপায়ে আঙুল ফুলে কলাগাছ হওয়া কিছু লোক এই বাজারে যদি হয়রান হয়, সেটা ভেবেই মাঝে মাঝে মজা লাগছে।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Labours wages banned notes
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE