Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪

দুই কেন্দ্র ফস্কে শুধুই আফশোস

জাল থেকে বের করার সময় হাত ফস্কে মাছ ফের নদীতে চলে গেলে জেলেদের কেমন লাগে, তা এখন বুঝতে পারছেন বড়জোড়া এবং বাঁকুড়া এলাকার তৃণমূল নেতা কর্মীরা। ঢাক-ঢোল ছিল। পটকা আনা হয়েছিল। লাড্ডু আনা হয়েছিল। বস্তা বস্তা আবির মজুত করে রাখা হয়েছিল। গণনার শুরুতেও সব ভালই চলছিল। প্রার্থী তরতর করে এগিয়ে যাচ্ছিলেন।

জোটের উল্লাস বাঁকুড়ায়। — নিজস্ব চিত্র

জোটের উল্লাস বাঁকুড়ায়। — নিজস্ব চিত্র

রাজদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়
বাঁকুড়া শেষ আপডেট: ২১ মে ২০১৬ ০২:১৭
Share: Save:

জাল থেকে বের করার সময় হাত ফস্কে মাছ ফের নদীতে চলে গেলে জেলেদের কেমন লাগে, তা এখন বুঝতে পারছেন বড়জোড়া এবং বাঁকুড়া এলাকার তৃণমূল নেতা কর্মীরা।

ঢাক-ঢোল ছিল। পটকা আনা হয়েছিল। লাড্ডু আনা হয়েছিল। বস্তা বস্তা আবির মজুত করে রাখা হয়েছিল। গণনার শুরুতেও সব ভালই চলছিল। প্রার্থী তরতর করে এগিয়ে যাচ্ছিলেন। কিন্তু শেষ ক’ রাউন্ডে সব হিসেব নিকেশ উল্টে, একটুর জন্য, বেমালুম হেরে গেলেন! পানসে মুখে বাড়ি ফিরতে ফিরতেও ঘোর কাটছিল না তৃণমূল কর্মীদের।

ভোটের ফল বেরোনোর পরে একটা পুরো দিন পার হয়ে গিয়েছে। রাজ্যজুড়ে উপচে পড়া সাফল্যের মধ্যেও জেলা তৃণমূলের চোখের বালি হয়ে রয়েছে বাঁকুড়া ও বড়জোড়া কেন্দ্র। দলের তরফে দক্ষিণ বাঁকুড়ার তিনটি কেন্দ্রে ভোটের বিশেষ দায়িত্ব পেয়েছিলেন অরূপ খাঁ। পুরো নম্বর পেয়ে পাশ করেছেন। কিন্তু মুখ ভার তৃণমূলের জেলা সভাপতি অরূপবাবুর। বলেই ফেললেন, “দক্ষিণ বাঁকুড়ায় ঐতিহাসিক জয় পেয়েছি। তালড্যাংরায় হারিয়ে দিয়েছি খোদ অমিয় পাত্রকে। এত কিছুর পরেও বাঁকুড়া আর বড়জোড়া নিয়ে আফশোসটা যাচ্ছে না।’’

যাবে কী করে? বাঁকুড়ায় ব্যবধান ১০২৯। বড়জোড়ায় ৬১৬। তীরে এসে তরী ডোবা যাকে বলে। দিনের শুরুতেও কোনও আঁচ ছিল না। গণনা যত এগিয়েছে, লড়াই তত জমে উঠেছে। উত্তেজনা উঠেছে চরমে। কর্মীরা অনেকেই বলছেন, ‘‘মাঝে মধ্যে মনে হচ্ছিল আইপিএল খেলা হচ্ছে বুঝি!’’ বাঁকুড়া কেন্দ্রে পঞ্চম রাউন্ডের গণনা শেষে দেখা যায়, তৃণমূল প্রার্থী মিনতি মিশ্র এগিয়ে রয়েছেন ১২০ ভোটে। ষষ্ঠ রাউন্ডের শেষে আবার খবর আসে, কংগ্রেসের শম্পা দরিপা ২৯৭ ভোটে পিছনে ফেলে দিয়েছেন মিনতিদেবীকে। সপ্তম রাউন্ডে আবার টেক্কা দিনেল মিনতিদেবী। ২৯৫ ভোটে এগিয়ে গেলেন শম্পাদেবীর থেকে। সেই খবর বাইরে যেতেই তৃণমূল কর্মীদের পটকা ও তাসার আওয়াজে গমগম করে উঠেছিল গণনাকেন্দ্র লাগোয়া শহরের কলেজ রোড। কয়েক হাজার মানুষের উল্লাসের চোটে ভড়কে গিয়ে কিছু পুলিশ কর্মী ভেবেছিলেন, কোনও ঝামেলা শুরু হয়েছে বুঝি। কিন্তু বাইরে বেরিয়ে দেখেন, ঝামেলা না। হুল্লোড়।

এর পরে দশম রাউন্ড মিটতেও খবর আসে, মিনতিদেবী আট’শ ভোটে এগিয়ে। তৃণমূল কর্মীদের আনন্দ তখন বাঁধ ভেঙেছে প্রায়। আবির নিয়ে তৈরি সবাই। মুখে মুখে ফিরছে— ‘‘আর কোনও চান্স নেই। আমরা জিতে গেলাম।’’ কিন্তু তার পরে মস্ত বিরতি। ভিতর থেকে বাইরে খবর আসা বন্ধ হয়ে যায়। গুঞ্জন উঠতে শুরু করেছে, মিনতিদেবী জিতে গিয়েছেন। কেউ বলছেন সাড়ে চারশো ভোটে। কেউ বলছেন আটশো ভোটে। সবুজ পাঞ্জাবি আর সবুজ আবির মেখে এক তৃণমূল কর্মী গজগজ করে বলছিলেন, ‘‘কাউন্টিং শেষ হতে এত দেরি করার কী আছে? তাড়াতাড়ি জয়ী ঘোষণা করে দিলেই তো মিছিলটা শুরু করে দেওয়া যেত।’’

সেই মিছিল আর হল না। দুম করে বাজ পড়ল মাথায়। খবর এল, ২০ রাউন্ডের সমস্ত গণনার শেষে মিনতিদেবী পরাজিত হয়েছেন। জোট কর্মীরা তো বটেই, এই খবর পেয়ে প্রথমে বিশ্বাস করতে পারেননি খোদ শম্পাদেবীই। শেষে হলের ভিতর থেকে নিশ্চিত খবর আসার পরে তৃণমূল কর্মীরা মুষড়ে পড়েন। আর মিইয়ে থাকা জোটের কর্মীরা গা ঝাড়া দিয়ে উঠে উল্লাসে ফেটে পড়েন।

একই ছবি বড়জোড়া কেন্দ্রে। এই কেন্দ্রের গণনা হয়েছে মোট ২১টি রাউন্ডে। তার মধ্যে প্রথম ১৬ রাউন্ড শেষে সোহম দেড় হাজারেরও বেশি ভোটে এগিয়ে ছিলেন। ২০ রাউন্ড শেষে সেই ব্যবধান কমে দাঁড়ায় ২৪। শেষ রাউন্ডে ৬১৬ ভোটে সিপিএমের সুজিত চক্রবর্তীর কাছে পিছিয়ে হার মানেন তৃণমূল এই তারকা প্রার্থী।

অঘটনটা ঘটল কী ভাবে? এই প্রশ্নটাই এখন তৃণমূল শিবিরে ঘুরে ফিরে বেড়াচ্ছে। বড়জোড়ার প্রার্থী মিনতিদেবীর কোনও কথা বলতে চাননি। তবে কেউ কেউ মনে করছেন, তৃণমূলের হয়ে বাঁকুড়ার পুরপ্রধান থাকাকালীন শম্পাদেবী শহরে জনপ্রিয়তা পেয়েছিলেন। তা প্রয়াত নেতা কাশীনাথ মিশ্রের স্ত্রী মিনতিদেবীকে হারিয়ে বিধানসভায় বাজিমাত করে ফেলেছেন তিনি।

আর বড়জোড়ায় হারের জন্য তৃণমূলকে প্রচার নিয়ে ঠেস দিচ্ছেন সিপিএমের জেলা কমিটির সদস্য সুজয় চৌধুরী। তিনি বলেন, “আমরা প্রত্যেকটা বুথে অন্তত তিন বার করে বাড়ি বাড়ি গিয়ে প্রচার করেছি। সেখানেই খামতি থেকে গিয়েছে তৃণমূলের।” ব্যাপারটা কার্যত মেনে নিয়েছেন বড়জোড়ার তৃণমূল নেতা অলক মুখোপাধ্যায়ও। তিনি বলেন, “তারকার কাছাকাছি থাকতে গিয়ে বাড়ি বাড়ি প্রচারে আমাদের ঢিলেমি পড়েছিল। অল্প ব্যবধান ডিঙোতে না পারার জন্য সেটাও কারণ হতেও পারে।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

alliance Left-Congress assembly vote results
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE