গ্রামের স্কুলে কোয়রান্টিনে সেন্টারে মনসুর। নিজস্ব চিত্র
আড়াই দশক পরে বাড়িছাড়া শ্রমিককে ঘরে ফেরাল ‘লকডাউন’।
মঙ্গলবার সকাল ৮টা। বাড়ির ভিতরে কাজ করছিলেন পুরুলিয়ার বান্দোয়ান থানার শিরকা গ্রামের অজিত সিং। তিনি বলেন, “হঠাৎ শুনি, কে একটা নাম ধরে ডাকছে। প্রথমে আমার স্ত্রী বেরিয়েছিল। চিনতে পারেনি। আমি বেরিয়ে থ!’’ অজিতবাবু দেখেন, ফিরে এসেছেন তাঁর ছোটবেলার বন্ধু মনসুর হেমব্রম। প্রায় পঁচিশ বছর কোনও খোঁজ ছিল না যাঁর। পথ চেয়ে দিন গুনতে গুনতে শেষে হাল ছেড়ে মেয়ের কাছে চলে গিয়েছেন মা। গ্রামের মধ্যে এখন শুধু পড়ে আছে ভাঙাচোরা মাটির বাড়িটা।
শিরকার বাসিন্দা জগেন্দ্রনাথ সিং বলেন, “সালটা ছিল ১৯৯৫। মনসুরকে নিয়ে আমরা মোট সাত জন গুজরাতের কাপড়াগঞ্জে গিয়েছিলাম কাজে। মাস ছ’য়েক পরে আমরা একে একে ফিরে এলেও ও সেখানেই থেকে গিয়েছিল। পরে অনেক চিঠি লিখেছি। উত্তর আসেনি।’’ গ্রামের বাসিন্দা মথন সিং বলেন, ‘‘ফুটবল, ভলিবল ভাল খেলত মনসুর। যাত্রাপালাও করত। যেখানে কাজে গিয়েছিল, সেখানে পরপর দু’টো বড় দুর্ঘটনার খবর পেয়েছিলাম। তখন ভেবেছিলাম, হয়তো কোনও অঘটন হয়েছে।’’
মনসুর তখন ছিলেন বছর কুড়ির। এখন বয়সের ছাপ পড়েছে চেহারায়। গ্রাম ছেড়ে গিয়েছিলেন যে বার, তখন বাড়িতে ছিলেন মা, অবিবাহিতা বোন আর দাদা। দাদার বিয়ে হয়েছিল পরে। কয়েকবছর পরে তাঁর মৃত্যুও হয়। বৌদি ফিরে যান বাপের বাড়ি। বিয়ে করে বোন এখন ঝাড়খণ্ডের পটমদার একটি গ্রামে থিতু। কয়েক বছর আগে মা লক্ষ্মী হেমব্রমও চলে গিয়েছিলেন মেয়ের কাছে।
মনসুরের ফেরার খবর পেয়েই ছুটে এসেছিলেন মা এবং বোন। কিন্তু কাছে যেতে পারেননি। ফেরার পরেই মনসুরকে বান্দোয়ান স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে যান গ্রামের বাসিন্দারাই। সেখানে লালারসের নমুনা সংগ্রহ করার পরে তাঁকে ‘হোম কোয়রান্টিন’ থাকার নির্দেশ দেয় হাসপাতাল। কিন্তু বাড়ি আর থাকার মতো দশায় নেই। আপাতত গ্রামের স্কুলে ‘কোয়রান্টিন’ রয়েছেন মনসুর।
দূর থেকে ছেলেকে দেখে কান্নায় ভেঙে পড়েন লক্ষ্মীদেবী। পরে বলেন, ‘‘এত বছর পরে ছেলেটা ফিরে এসেছে বলে খুব ভাল লাগছে। ভেবেছিলাম, আর হয়তো ফিরবে না। কেন যে যোগাযোগ করেনি, সেটাই ভেবে পাচ্ছি না।’’
মনসুর জানান, গুজরাত থেকে রাজস্থান। পরে মহারাষ্ট্র। নানা জায়গায় কাজের সূত্রে ঘুরেছেন তিনি। যন্ত্রে লোহা কাটার কাজ করতেন। বলেন, ‘‘এক সময় মনে হয়েছিল, বাড়ি ফিরব না। পরে কয়েকবার চিঠি লিখেছিলাম। উত্তর আসেনি। লকডাউনে দু’মাস কাজ বন্ধ থাকায় সবাই বাড়ি ফিরে গেল। ওখানে একা হয়ে গিয়েছিলাম। তাই বাড়ি ফিরে এলাম।’’
বান্দোয়ান পঞ্চায়েতের সদস্য তথা ওই গ্রামের বাসিন্দা মৃগেন সিং আর মনসুর ছোটবেলার বন্ধু। মৃগেন বলেন, ‘‘এক সময়ে ভেবেছিলাম ও হয়তো বেঁচে নেই। ফিরে আসায় খুব ভাল লাগছে। মনে হচ্ছে, লকডাউন উঠে গেলে আবার আগের দিনগুলোয় ফিরে যাব। এক সঙ্গে চুটিয়ে ফুটবল খেলব।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy