সাজা ঘোষণার পরে (বাঁ দিক থেকে) বিজয়, ধীরজ ও বিনীত। পুরুলিয়া আদালতে। ছবি: সুজিত মাহাতো
ব্যবসায়ী দম্পতি খুনের মামলায় প্রধান অভিযুক্ত বিজয় আগরওয়ালের যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের নির্দেশ হল। অন্য দুই অভিযুক্ত বিনীত আগরওয়াল ও ধীরজ আগরওয়ালের ছ’বছর কারাদণ্ডের নির্দেশ হয়েছে। বৃহস্পতিবার তাদের দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছিল। শুক্রবার এই রায় দিলেন পুরুলিয়ার জেলা ও দায়রা বিচারক বিশ্বরূপ চৌধুরী।
ঘটনাটি পুরুলিয়া শহরের। সালটা ২০১২। নীলকুঠিডাঙার বাড়িতে থাকতেন রামশঙ্কর কোঠারি ও সুশীলা কোঠারি। রামশঙ্করবাবুর বয়স সত্তরের কোঠায়। সুশীলাদেবী ষাট পেরিয়েছেন। তাঁদের ছেলে সুনীল থাকেন দিল্লিতে। তিনি বলছিলেন, ‘‘অফিস থেকে ফিরে রোজ বাড়িতে ফোন করতাম। ২৮ এপ্রিল রাত সাড়ে ১০টা নাগাদ ফোন করি। বাবা-মা দু’জনের ফোনই বন্ধ।’’
খটকা লাগে সুনীলের। পুরুলিয়া শহরেই তাঁর বন্ধু সন্দীপ টিবরিওয়ালের বাড়ি। তাঁকে ব্যাপারটা বলেন। সকালে সন্দীপ যান খোঁজ নিতে। ধাক্কা দিতেই খুলে যায় রামশঙ্করবাবুর বাড়ির দরজা। দেখা যায়, শোওয়ার ঘরে পড়ে রয়েছে দম্পতির রক্তাক্ত দেহ। গলার নলি কাটা। ঘরে আলো জ্বলছে। টিভি চলছে। সন্দীপই থানায় অভিযোগ দায়ের করেন।
সূত্র ধরে
মামলার সরকারি আইনজীবী পার্থসারথি রায় জানান, তদন্তে গিয়ে পুলিশের চোখে পড়ে তিনটি বিষয়। শোয়ার ঘরে প্লেটে পড়ে আধখাওয়া মিষ্টি আর ভুজিয়া। আঁচ করা হয়, খুনটা এমন কেউ করেছে যাকে দম্পতি অন্দরমহলে নিয়ে গিয়ে মিষ্টি খাইয়েছিলেন। ঘরের মধ্যেই পাওয়া যায় একটা মার্বেলের দোকানের ‘স্লিপ’। তার উল্টো দিকে গয়না সংক্রান্ত কিছু হিসেবনিকেশ লেখা।
বাড়ির জিনিসপত্র ঘেঁটে ব্যাঙ্কে লেনদেনের একটা নথি মেলে। তদন্তে জানা যায়, লেনদেন হয়েছিল বিজয় আগরওয়াল নামে এক জনের সঙ্গে। খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, মার্বেলের দোকানটিও বিজয়ের। সুনীল পুলিশকে জানান, রামশঙ্করবাবু দিন কয়েক আগে মেয়ের কাছে বিজয়ের নাম করেছিলেন। তার টাকা ফেরত দিতে আসার কথা ছিল।
আরও একটি সূত্র অপেক্ষা করছিল তদন্তকারীদের জন্য। এক পড়শি জানান, ২৮ এপ্রিল সন্ধ্যা থেকে সাদা রঙের ছোট একটা গাড়ি রামশঙ্করবাবুর বাড়ির সামনে ঠায় দাঁড়িয়েছিল। রাত সাড়ে ১০টা নাগাদ তিনি যখন বাইরে পায়চারি করছেন, তখন গাড়িটিকে বেরিয়ে যেতে দেখেছেন। খোঁজ মিলছিল না রামশঙ্করবাবুর মোবাইল ফোনের। সেটি উদ্ধার হয় একজনের থেকে। পুলিশ জানতে পারে, সাহেববাঁধের কাছে তিনি ফোনটি কুড়িয়ে পেয়েছেন। বিজয়ের ফোনের টাওয়ার লোকেশন খতিয়ে দেখা যায়, ওই রাতে সেও সাহেববাঁধ হয়ে দেশবন্ধু রোডের বাড়িতে ফিরেছে।
এরই মধ্যে, ৪ মে বিজয় নিজেই থানায় হাজির হয়। পাসপোর্টের জন্য পুলিশের থেকে ছাড়পত্র নিতে। এ বারে গ্রেফতার করা হয় তাকে। শুরু হয় জেরা। গোড়ায় কবুল না করলেও পুলিশ একের পরে এক তথ্য আর প্রমাণ হাজির করতে থাকে। তদন্তকারীদের দাবি, তাতেই ভেঙে পড়ে অভিযুক্ত। স্বীকার করে, দিল্লি থেকে ভাগ্নে বিনীত আগরওয়াল ও তার বন্ধু ধীরজ আগরওয়ালকে নিয়ে এসেছিল খুনটা করার জন্য। দিল্লি গিয়ে ধরে আনা হয় তাদেরও।
জাল গোটানো
এর পরে তিন অভিযুক্তকে নিয়ে ঘটনার পুনর্নির্মাণ করায় পুলিশ। সাহেববাঁধ থেকে উদ্ধার হয় খুনে ব্যবহৃত ছুরি। রামশঙ্করবাবুর বাড়ির একটি কাপ— পাছে হাতের ছাপ ধরা পড়ে যায় সেই ভয়ে লোপাট করা হয়েছিল। ঘটনার ৮৪ দিন পরে আদালতে জমা পড়ে চার্জশিট। বিচার শুরু হয় ২০১২-র ডিসেম্বরে।
সুনীলের আইনজীবী রবীন্দ্রনাথ চট্টরাজ বলেন, ‘‘ঘটনার কোনও প্রত্যক্ষদর্শী ছিল না। কিন্তু পুলিশ প্রচুর তথ্যপ্রমাণ এমন ভাবে তুলে ধরেছিল, যে অপরাধ কবুল করা ছাড়া অভিযুক্তদের কাছে আর কোনও রাস্তা খোলা ছিল না।’’ তিনি জানান, এই মামলায় সাক্ষ্য দিয়েছেন মোট ৪১ জন। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন দিল্লি থেকে আসার পথে যে হোটেলে ধীরজ আর বিনীত ছিলেন, সেখানকার লোকজন। পথে একটি ধাবায় খেয়েছিলেন তিন জন মিলে। সেখানের লোকজনও সাক্ষ্য দেন।
কেন খুন?
রামশঙ্করবাবুর গয়নার দোকান ছিল শহরে। পাশাপাশি তেজারতি কারবারও করতেন। রবীন্দ্রনাথবাবু জানান, বিজয় গয়না বন্ধক দিয়ে প্রায় ৬০ লক্ষ টাকা ধার করেছিল ওই ব্যবসায়ীর থেকে। প্রতি মাসে মোটা অঙ্কের সুদ দিত। তাঁর দাবি, একটা সময়ে রফা হয়, বিজয় আসলের টাকা দিয়ে গয়না ফেরত নিয়ে যাবে। সেই কথা মতোই ২৮ এপ্রিল সন্ধ্যায় দুই সঙ্গীকে নিয়ে হাজির হয় সে।
রবীন্দ্রনাথবাবু জানাচ্ছেন, তদন্তে উঠে এসেছে— খুনের পরে অস্ত্র এবং মোবাইল লোপাট করে দুই সঙ্গীকে নিয়ে বিজয় বাড়ি ফিরে গিয়েছিল। সেখান থেকে পরের দিন ভোরে অন্য একটি গাড়িতে সটান রাঁচী। বিমানের টিকিট কাটা ছিল। সঙ্গীদের দিল্লি রওনা করিয়ে দেয় সে। নিজের সাদা গাড়িটি আসানসোলের একটি গ্যারাজে ধুতে পাঠিয়ে দিয়েছিল বিজয়।
রায় ঘোষণা
ঘটনার পরে তোলপাড় হয়েছিল জেলা। এই মামলার রায় কী হয়, সেটা শুনতে পুরুলিয়া কোর্টে ছিল ভিড়। আদালতে তোলার সময়ে অভিযুক্তেরা কোনও কথা বলেনি। তবে বিচারক রায় দেওয়ার আগে তাঁদের বক্তব্য জানতে চাইলে, তিন জনই নিজেদের নির্দোষ বলে দাবি করেছে।
অভিযুক্ত পক্ষের আইনজীবী অরূপ ভট্টাচার্য জানিয়েছেন, এই রায়ের বিরুদ্ধে তাঁরা উচ্চতর আদালতে আপিল করবেন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy