Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪

ক্ষতির ক্ষত সারবে কী ভাবে, প্রশ্ন

কৃষি দফতর দুষছে বিমা করার দায়িত্ব পাওয়া বিমা সংস্থাকে। জেলার উপ-কৃষি অধিকর্তা আশিস বন্দ্যোপাধ্যায় জানান, পুরুলিয়ায় কৃষকের সংখ্যা কমবেশি তিন লক্ষ ২০ হাজার।

শুভ্রপ্রকাশ মণ্ডল
রঘুনাথপুর শেষ আপডেট: ০৪ নভেম্বর ২০১৮ ১২:০৫
Share: Save:

মাঠের পর মাঠ ধান জলের অভাবে শুকিয়ে যাচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে চাষিদের ক্ষতি কিছুটা হলেও সামাল দিতে পারত শস্যবিমা। কিন্তু, সে উপায়ও নেই। পুরুলিয়া জেলার প্রায় ৯০ শতাংশ চাষিকেই যে ফসল বিমার আওতায় আনা যায়নি, তা মানছেন কৃষি দফতর। ফলে মাঠে ধান মারা গেলেও বিমার সুবিধা থেকে এ বছরও বঞ্চিতই থেকে যাচ্ছেন জেলার অধিকাংশ কৃষক।

কেন এই অবস্থা?

কৃষি দফতর দুষছে বিমা করার দায়িত্ব পাওয়া বিমা সংস্থাকে। জেলার উপ-কৃষি অধিকর্তা আশিস বন্দ্যোপাধ্যায় জানান, পুরুলিয়ায় কৃষকের সংখ্যা কমবেশি তিন লক্ষ ২০ হাজার। তাঁদের মধ্যে ফসল বিমার আওতায় এসেছেন মোটে ৩০ হাজারের কিছু বেশি কৃষক। আশিসবাবুর দাবি, ‘‘ওই ৩০ হাজার চাষিকে বিমার আওতায় আনা সম্ভব হয়েছে, ব্লকের কৃষি দফতরগুলির সদর্থক উদ্যোগের ফলেই। যে সংস্থা বিমা করানোর দায়িত্বে ছিল, তারা ঠিক ভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারেনি বলেই চাষিদের বিমার আওতায় আনা সম্ভব হয়নি।” জেলাশাসক অলকেশপ্রসাদ রায়ের অভিযোগ, ‘‘ফসল বিমা করার দায়িত্ব পাওয়া সংস্থা চুক্তি অনুযায়ী কাজ করতে পারেনি। ওদের সরিয়ে অন্য সংস্থাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।” চেষ্টা করেও অবশ্য আগের ওই বিমা সংস্থার কারও সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়নি।

এ বছর জেলার ৩ লক্ষ ২৫ হাজার হেক্টর জমিতে আমন ধানের চাষ হয়েছে। কিন্তু, টানা অনাবৃষ্টিতে চাষিদের মনে ঘনিয়েছে আশঙ্কা। আমন চাষের পরিস্থিতি যে এ বছর ঘোরাল, মানছেন উপ-কৃষি অধিকর্তাও। তাঁর কথায়, ‘‘আমন চাষের পরিস্থিতি ভাল নয়। ফলন অনেকটাই কম হবে বলেই মনে হচ্ছে।”

শস্য-ক্ষতির আঁচ যাতে কম পড়ে, সে জন্য বিমার প্রয়োজন। কৃষি দফতর সূত্রে জানা যাচ্ছে, তিন ধরনের শস্য বিমা করানোর উপায় রয়েছে। প্রথমত, ফসল বিমা করা থাকলে আমন ধানের ক্ষেত্রে কৃষকেরা হেক্টর প্রতি প্রায় ৫৭ হাজার টাকা পাবেন। কিন্তু, সেই সুযোগ অনেক চাষিই পাবেন না।

দ্বিতীয়ত, কিসান ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে চাষিরা কৃষি-ঋণ নিয়ে চাষ করে থাকলে, বিমার আওতায় চলে আসবেন। ফলে ফসলের ক্ষতি হলে চাষিকে ঋণের একটা বড় অংশ শোধ করতে হবে না। জেলার ৭৭ শতাংশ চাষিকে কিসান ক্রেডিট কার্ড দেওয়া হয়েছে। কিন্তু, কত সংখ্যক চাষি ওই কার্ড পেয়ে ঋণ নিয়ে চাষ করছেন, সে ব্যাপারে কৃষি দফতরের কাছে কোনও তথ্য নেই।

তৃতীয়ত, কৃষি সমবায় সমিতি ওই কার্ডের মাধ্যমেই কৃষকদের ঋণ দেন। কিন্তু, সে ক্ষেত্রে নিয়ম হচ্ছে চাষিরা যদি সমবায় গঠন করে কারও জমি লিজ নিয়ে চাষ করেন, তাহলে সমবায় থেকে তাঁদের ঋণ দেয়। সমবায়ের সদস্যেরাও নিজেদের জমি চাষের জন্যও ঋণ নিতে পারেন। খরা ঘোষণা করা হলে বা প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে চাষের ক্ষতি হলে ক্রেডিট কার্ড প্রাপকদের ঋণের একটা বড় অংশ মকুব হয়ে যায়।

ফসল বিমা করানোর কাজের এই পরিণতি কেন হল?

কৃষি দফতরের দাবি, নিয়ম অনুযায়ী কৃষককে বুঝিয়ে এই ফসল বিমা করানোর কথা সংস্থাটির কর্মীদের। তাঁদের সহায়তা করবে কৃষি দফতর। কিন্তু, কার্যক্ষেত্রে দেখা গিয়েছে, যে সব ব্লকের কৃষি আধিকারিকেরা চাষিদের বিমার ফর্ম পূরণ করে ওই সংস্থার হাতে দিয়েছে, সেগুলিই শুধু বিমার আওতায় এসেছে। আর যে সব ব্লকের কৃষি দফতর বিমা সংস্থাটির উপরে নির্ভর করেছিল, তাদের ডুবতে হয়েছে। রঘুনাথপুর ২ ব্লকের প্রায় সাত হাজার কৃষক ফসল বিমার আওতায় এসেছেন। অন্যদিকে, খুবই কম বিমা হয়েছে পাড়া, কাশীপুর, বরাবাজার, আড়শা, হুড়ার মতো ব্লকগুলিতে। পাড়ায় বিমা হয়েছে প্রায় পাঁচশো জনের। জেলার সব থেকে বড় ব্লক কাশীপুরে বিমা হয়েছে প্রায় সাড়ে চারশো কৃষকের। আড়শার ক্ষেত্রে এই সংখ্যাটা পাঁচশোর কিছু বেশি, বরাবাজারে আড়াইশো।

তাহলে কৃষি দফতরই কেন আগে উদ্যোগী হয়নি?

কৃষি আধিকারিকদের একাংশ বিমা করানোর সময় নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। তাঁদের অভিযোগ, ফসল বিমা করানোর সময়সীমা ছিল ১ জুলাই থেকে ৩১ জুলাই। কয়েকটি ব্লকের সহকারী কৃষি অধিকর্তারা জানাচ্ছেন, ওই সময়ে চাষিরা মাঠে পড়ে থাকেন। চাষের কাজ ফেলে তাঁদের পক্ষে ব্লক অফিসে বিমা করাতে যাওয়া সম্ভব ছিল না। সেটাই বাস্তবে ঘটেছে। কয়েকটি ব্লকের সহকারী কৃষি অধিকর্তার কথায়, ‘‘গ্রামে গ্রামে ঘুরে কৃষকদের বুঝিয়ে জমি সংক্রান্ত নথি জোগাড় করে অনলাইনে ফর্ম পূরণ করিয়ে বিমা করানোর মত পরিকাঠামো ব্লকের কৃষি দফতরগুলির নেই। ফলে নির্ভর করতে হয়েছিল বিমা সংস্থাটির উপরে।

ফসল মাঠেই নষ্ট হওয়ার মত পরিস্থিতি তৈরি হলেও শস্য বিমা কৃষকেরা পাবেন কি না সেটা এখনই বলা সম্ভব নয় বলে দাবি করেছে কৃষি দফতর। নিয়ম অনুযায়ী, বিমা পাওয়ার আগে কৃষি দফতর পঞ্চায়েত পিছু চারটি মৌজা ঠিক করে সেখানে পরীক্ষামূলক ভাবে ধান কাটবে। কোনও মৌজার কোনও একটি জমি চিহ্নিত করে সেখানে ধান কাটার পরে কাঁচা ওজন নেওয়া হবে। তার সাত দিন পরে নেওয়া হবে শুকনো ওজন। যদি দেখা যায় শুকনো ধানের ওজনের পরিমাণ হেক্টরের প্রত্যাশার থেকে অনেকটাই কম। তাহলেই বিমা পাওয়ার যোগ্য বলে বিবেচিত হবেন কৃষকেরা। নভেম্বর মাসের মাঝামাঝি থেকে পরীক্ষামূলক ভাবে ধান কাটার কাজ শুরু করবে ব্লকের কৃষি দফতরগুলি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Insurance Farmers Corps
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE