প্রতীকী ছবি।
বাড়িতে সাত জনের ঘেরাটোপে ঘুমোচ্ছিল চোদ্দ দিনের এক শিশু। ভোরে সেখান থেকেই উধাও হয়ে যায় সে। পড়শিদের কারও আশঙ্কা ছিল, তাকে কেউ চুরি করেছে। কেউ আবার ভাবছিলেন, কুকুরে টেনে নিয়ে যায়নি তো? তদন্তে নেমে শিশু মা, বাবা ও ঠাকুমাকে টানা জিজ্ঞাসাবাদ চালায় পুলিশ। তদন্তকারীদের দাবি, ঘণ্টা ছয়েকের জেরায় হঠাৎ শিশুর মা তাঁদের কাছে স্বীকার করেন, ‘ছেলেটাকে একটুও ভাল লাগছিল না। তাই কুয়োয় ফেলে দিয়েছি’। পরে সেই বাড়ির কুয়োয় তল্লাশি চালিয়ে উদ্ধার হয় শিশুটির দেহ।
বাঁকুড়া সদর থানার করণজোড়া গ্রামের এই ঘটনায় তাজ্জব অনেকেই। নিজের ছেলেকে খুনের অভিযোগ পুলিশ গ্রেফতার করেছে মা রচনা বাউরিকে। শুক্রবার তাঁকে বাঁকুড়া আদালতে তোলা হলে ১৪ দিনের জেল হাজতের নির্দেশ হয়। বাঁকুড়ার পুলিশ সুপার কোটেশ্বর রাও বলেন, “ওই বধূকে নিজের সন্তানকে খুনের অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়েছে। পুলিশ স্বতঃপ্রণোদিত মামলা করে তদন্ত করছে।”
পরিবার সূত্রে খবর, এক বছর আগে করণজোড়ার বাসিন্দা আশিস বাউরির সঙ্গে রচনার বিয়ে হয়। ৭ অগস্ট বাঁকুড়া মেডিক্যালে তিনি একটি পুত্র সন্তানের জন্ম দেন। দিন পাঁচেক আগে হাসপাতাল থেকে ছুটি পেয়ে সন্তানকে নিয়ে তিনি শ্বশুরবাড়িতে ফেরেন।
আশিসের জেঠা নন্দলাল বাউরি জানান, একটি ঘরেই স্বামী, ঠাকুমা, শ্বশুর, শাশুড়ি, পিসিশাশুড়ি ও ননদকে নিয়ে থাকেন রচনা। জায়গার অভাবে রাতে কিছু সদস্য বারান্দায় ঘুমান। বুধবার রাতে ঘরে ছিলেন আশিস, রচনা ও তাঁদের সদ্যোজাত ওই শিশু। বাকিরা বারান্দায় শুয়েছিলেন। ভোর ৩টে নাগাদ শিশুটি কেঁদে ওঠে। রচনা ও তাঁর শাশুড়ি শিশুটিকে ঘুম পাড়ান। বৃহস্পতিবার ভোর ৫টা নাগাদ রচনা তাঁর শাশুড়ি লোটনদেবীকে ঘুম থেকে তুলে জানান, ছেলেকে খুঁজে পাচ্ছেন না।
নন্দলালবাবু বলেন, “শিশুটিকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না শুনে হইচই পড়ে যায়। বাড়ির এত জন লোকের মাঝ থেকে শিশুটি কী ভাবে উধাও হয়ে গেল, কেউ বুঝতে পারছিলাম না। চারদিকে খোঁজাখুঁজি শুরু হয়। হদিশ না পেয়ে শেষে পুলিশে খবর দেওয়া হয়। পুলিশ এসেও বাড়ির চার পাশে খোঁজাখুজি করে হদিস না পেয়ে রচনা, আশিস ও লোটনদেবীকে থানায় নিয়ে যায়।’’
তদন্তকারী এক আধিকারিক দাবি করেন, তাঁদের নানা প্রশ্ন করা হচ্ছিল। হঠাৎ রচনা একবার বলে বসেন, তিনি খুন করেননি। সন্দেহ হওয়ায় চেপে ধরতেই ভেঙে পড়েন তিনি। ওই আধিকারিক বলেন, “লাগাতার প্রশ্নের মুখে উত্তেজিত হয়ে রচনা বলে ফেলেন ‘তোমরা কুয়োতে গিয়ে খোঁজ। ওকে আমার একটুকুও ভাল লাগেনি বলে আমি নিজে সেখানে ফেলে দিয়েছি’।
কেন এমন ঘটনা ঘটল? তদন্তকারীদের একাংশের দাবি, বছর আঠারোর রচনার মধ্যে মাতৃত্ববোধ সে ভাবে গড়ে ওঠেনি। উল্টে সন্তান জন্ম দেওয়ার ধকলের ফলে মানসিক পরিবর্তন ঘটে যাওয়া অস্বাভাবিক নয়। ইতিপূর্বে এই জেলাতেই মায়ের হাতে সদ্যোজাতের মৃত্যুর অভিযোগ কয়েকবার উঠেছে।
বাঁকুড়া মেডিক্যালের অধ্যক্ষ পার্থপ্রতিম প্রধান বলেন, “সন্তান জন্মানোর এক মাসের মধ্যে মহিলাদের প্রসবোত্তর বিকার বা পিয়ারপেরাল সাইকোসিসে আক্রান্ত হওয়ার একটা প্রবণতা থাকে। এই সময় শরীরের নানা হরমোনের অসামাঞ্জস্যতার কারণেই এমনটা হয়। এর থেকে মুক্তির জন্য কাউন্সেলিং বা পরিবারের অন্য সদস্যদের পাশে দাঁড়ানো খুবই দরকার।”
মানসিক ভাবে ভেঙে পড়ায় শিশুর বাবার সঙ্গে কথা বলা যায়নি। আক্ষেপ করতে করতে নন্দলালবাবু বলেন, “রচনার মধ্যে কোনও দিন মানসিক অবসাদ দেখিনি। সুস্থ, স্বাভাবিক মেয়ে। এমন ঘটনা ঘটাতে পারে কল্পনাও করতে পারছি না!”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy