সরু গলিতে ভিড়। ছবি: সুজিত মাহাতো
সরু গলি। উপরে তারের জাল। কোনটা বিদ্যুতের, কোনটা জেনারেটরের, কোনটা টেলিফোনের বা কোনটা কেবল টিভির— আলাদা করা মুশকিল। কলকাতার নন্দরাম মার্কেট থেকে বাগড়ি মার্কেট এমনই অসতর্কতায় পুড়ে গেলেও তা থেকে শিক্ষা নেয়নি পুরুলিয়ার কাপড় গলি। এখনও এই কাপড়ের বাজারে ঘুরলে দেখা যায়, চায়ের দোকানে স্টোভ জ্বলছে। আর সেই আগুনের নাগালের মধ্যেই পাশের দোকান থেকে বাইরে ঝুলছে পোশাক। যা দেখে বাসিন্দাদের প্রশ্ন, আর কবে বদলাবে মানসিকতা?
শহরের প্রবীণ বাসিন্দারা জানাচ্ছেন, ১৮৩৮ সালে মানবাজার থেকে মানভূমের সদর পুরুলিয়ায় উঠে আসে।
তার পরে জনবসতি বাড়তে থাকায় গড়ে ওঠে চকবজার এলাকা। তার পাশেই গড়ে ওঠে কাপড় গলি। এই বাজারে পাইকারী ও খুচরো মিলিয়ে কমবেশি শ’দুয়েক দোকান রয়েছে। অধিকাংশই কাপড়ের দোকান। অল্প কিছু প্রসাধন সামগ্রীর দোকানও রয়েছে। প্রতি দিন সকাল থেকে রাত পর্যন্ত থিকথিকে ভিড় থাকে এই বাজারে।
যদি কোনও দিন ভরা বাজারে আগুন ধরে যায়, কী হবে? বাগড়ি-কাণ্ডের পরে পুজোর মুখে এই আশঙ্কা উঁকি দিচ্ছে শহরের অনেক বাসিন্দার মনে। ব্যবসায়ীরা বলছেন— উপরওয়ালাই ভরসা। ছোটখাটো বিপর্যয় যে হয়নি, তা নয়। কাপড় গলির পুরনো ব্যবসায়ী রাজকুমার মোহতা বলেন, ‘‘আমার দোকানের সামনেই বিদ্যুতের তারে কয়েকবার শটসার্কিট থেকে আগুন লেগেছে। আতঙ্কে লোকজন ছোটাছুটি শুরু করেন। কোনও রকমে দমকলের গাড়ি ঢুকতে পেরেছিল। কিন্তু গলির আরও ভিতরে আগুন লাগলে দমকলও ঢুকতে পারবে না।’’
মাকড়শার জালের মতো ঝুলছে বিদ্যুতের তার। ছবি: সুজিত মাহাতো।
বেশ কয়েক বছর আগে এই গলির মুখের একটি দোকান ভস্মীভূত হয়ে যায়। সেই দোকানের মালিক রতন পোদ্দার জানাচ্ছেন, ‘‘সে বার আগুনে আমার দোকানের দোতলা সম্পূর্ণ পুড়ে যায়। পুরুলিয়ার দমকলের ইঞ্জিন আগুন নেভানো শুরু করলেও আরও জলের প্রয়োজন ছিল। রঘুনাথপুর থেকে দমকলের ইঞ্জিন পৌঁছনোর আগেই সব পুড়ে ছাই হয়ে যায়।’’
এখন আগুন লাগলে কী হবে?
রতনবাবু বলেন, ‘‘অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র রেখেছি। কিন্তু, ওই যন্ত্র ব্যবহারের প্রশিক্ষণ আমাদের নেই। কাজেই ভরসা সেই দমকল।’’ আর এক ব্যবসায়ী বিশ্বরূপ দত্তের দাবি, প্রতিটি দোকানকে বাধ্যতামূলক ভাবে অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র রাখতে দমকল ও পুরসভার চাপ দেওয়া উচিত। ব্যবসায়ী ও কর্মীদেরও ওই যন্ত্র ব্যবহারের প্রশিক্ষণ দিতে হবে। তা হলে সরু গলির ভিতরে দমকলের কর্মীরা পৌঁছনোর আগে পর্যন্ত দোকানি ও কর্মীরাই অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র নিয়ে আগুনের বিরুদ্ধে লড়াই চালানোর চেষ্টা করতে পারবেন।
যদিও পুরুলিয়া দমকল কেন্দ্রের আধিকারিকদের বক্তব্য, এখানে বড়সড় অগ্নিকাণ্ড না ঘটলেও একাধিকবার ছোট বা মাঝারি অগ্নিকাণ্ড হয়েছে। আগুনের মোকাবিলা করতে গিয়ে দমকল কর্মীরা দেখেছেন, গোটা বাজারে জলের কোনও ব্যবস্থা নেই। তাই এই বাজারের ব্যাপারে তাঁরা পুরসভাকে অনেক আগেই সতর্ক করেছেন।
দমকল কেন্দ্রের এক আধিকারিক বলেন, ‘‘আমাদের ছয় হাজার লিটারের একটি ট্যাঙ্কার রয়েছে। অন্যগুলি আড়াই হাজার লিটারের। আগুন মোকাবিলার সময় ছয় হাজার লিটারের ট্যাঙ্ক খালি হতে বড় জোর মিনিট দশেক সময় লাগে। যদিও জলের ফোর্স একটি নিয়ন্ত্রণে রাখা হয়। আর পুরো ফোর্স ছাড়া হলে দশ মিনিটের কম সময়েই ট্যাঙ্কার খালি হয়ে যাবে। আড়াই হাজার লিটারের ট্যাঙ্কার খালি হতে আর কত টুকু সময় লাগবে? কিন্তু, কাছাকাছি কোথাও জলের সংস্থান না থাকায় ওই বাজারে আগুন নেভানো মুশকিল
হয়ে পড়বে।’’
তাঁর মতে, ওই বাজারে খুচরো কাপড়ের দোকান যেমন রয়েছে, তেমনই বেশ কয়েকটি পাইকারি কাপড়ের দোকান ও গুদাম রয়েছে। তাঁদের নিজেদের স্বার্থেই অবিলম্বে ওই এলাকায় আগুন নেভানোর জন্য জলের সংস্থান করা উচিত।
পুরুলিয়ার পুরপ্রধান সামিমদাদ খান বলেন, ‘‘ইংরেজ আমলে কাপড়গলি চালু হয়। দীর্ঘদিন ধরে ওই ভাবেই বাজার চলছে। দমকল বিভাগের ছাড়পত্র নেই বলে আমরা যদি ট্রেড লাইসেন্স পুনর্নবীকরণ না করি, তাহলে অনেক দোকানই বন্ধ হয়ে যাবে। আমরা পুরসভার বিপর্যয় ব্যবস্থাপন ও মোকাবিলা দফতরের মাধ্যমে ওই বাজারের ব্যবসায়ীদের সচেতন করার কাজ শুরু করেছি।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy