হতাশ: নিজেদের দোকানে আব্দুল গনি। নিজস্ব চিত্র
কখনও সম্পূর্ণ ধারে। কখনওবা সাবেক বিনিময় পদ্ধতি মেনে নির্দিষ্ট পরিমাণ ধানের পরিবর্তে সমমূল্যের বিষ্কুট বা ডাল। ঠিক এক বছর আগে ৮ নভেম্বর রাতে পাঁচশো, হাজারের নোট বাতিলের ঘোষণার পরে এমনই ছবি দেখা গিয়েছিল ঝাড়খণ্ড লাগোয়া বাংলার শালজোড় গ্রামে। সেই দুর্দিনে নিজেদের ছোট্ট মুদিখানা সম্বল করে ধার আর বিনিময় ব্যবস্থার পথে হেঁটে গ্রামের কৃষিজীবী পরিবারগুলির পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন আব্দুল গনি, তাহসেনা বিবি।
নোটবন্দির বর্ষপূর্তিতে এসে গ্রামের মানুষের দুর্ভোগ কমলেও বেকায়দায় পড়েছেন ওই দুই ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী। দুই ব্যবসায়ী জানাচ্ছেন, নোটবন্দির সময় গ্রামের মানুষ যে ধার করেছিলেন, তার একটা বড় অংশ এখনও তাঁরা না মেটানোয় পুঁজির অভাবে আমাদের দোকানে তালা পড়ার জোগাড়। তাহসেনা বলছেন, ‘‘৫৫ হাজার টাকা বাকি।’’ পাশ থেকে গনি যোগ করছেন, ‘‘প্রায় ৮০ হাজার টাকা পাব। সকলেই বলছেন দিচ্ছি, দেব। কিন্তু আদায় আর হচ্ছে না।’’ মাস কয়েক আগে গ্রামেই আরও একটি মুদির দোকান খোলার পরে সমস্যা বেড়েছে।
তাহসেনা বিবি। নিজস্ব চিত্র
গত বছর ঠিক এই সময়ে চরম সমস্যায় ছিলেন খয়রাশোলের লোকপুর পঞ্চায়েতের ওই গ্রামের মানুষ। বাংলারই গ্রাম, অথচ গ্রামে ঢুকতে হলে ঝাড়খণ্ডের দুটি গ্রাম পার হয়ে ঢুকতে হয়। বাংলার মধ্যে দিয়ে ওই গ্রামে যাওয়ার কোনও রাস্তাই নেই। নেই কোনও যোগাযোগ ব্যবস্থা। গ্রাম থেকে ডাকঘর ১৪ কিমি। গ্রামীণ ব্যাঙ্কের দূরত্ব কম করেও আট কিমি। খয়রাশোলের রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের দূরত্ব ১৬ কিমি। গ্রামে ৭০-৭৫টি পরিবার। শ’চারেক বাসিন্দার মধ্যে হিন্দু-মুসলিম প্রায় সমান সমান। প্রায় সকলেই কৃষিজীবী।
গ্রামের বাসিন্দা রুবেল আহমেদ, ইনজামাম হোসেন, শেখ আতাউল, শরৎ বাউড়ি, শোভন বাউড়িদের মনে এখনও ভাসে সেই সব দিনের কথা। তাঁরা জানান, নোট বাতিলের সিদ্ধান্তের পরই মাথায় হাত পড়ে গিয়েছিল। কেউ পুরনো নোট নিতে চাইত না। অনেকে বহু কষ্টে ব্যাঙ্ক বা পোস্টঅফিসে পুরোনো নোট জমা দিতে পেরেছিলেন। কিন্তু, টাকা ফেরত পেতে ঘাম ছুটেছিল। এঁদের কেউ জমির মালিক, তো কেউ কৃষি-শ্রমিক। ধান উঠলেও তা বিক্রি করে যে টাকা পাব সে রাস্তাও বন্ধ ছিল। মজুরিও ধান দিয়ে মেটানো হচ্ছিল। নগদ টাকার অভাবে দৈনন্দিন খাবার কেনার জায়গা ছিল না। সেই সময় সহায় হয়েছিলেন আব্দুল, তাহসেনারা।
যাঁরা গ্রামের মানুষকে এ ভাবে সাহায্য করলেন, তাঁদের আজ এমন অবস্থা কেন?
রুবেল, মহম্মদ বাসিব, সইদ আনোয়ারের মতো বাসিন্দার কথায়, ‘‘ওঁরা অসময়ে সাহায্য করার পরেও কিছু মানুষ ওঁদের টাকা মেটাননি এটা সত্যি। তবে গ্রামের মূল রাস্তায় একটি নতুন দোকান হওয়ায় ওঁরা বেশি বেকায়দায় পড়েছেন। তা ছাড়া ওঁদের কাছ থেকে জিনিস কিনলে একটু বেশি দাম দিতে হচ্ছিল। খদ্দের তো নিজের সুবিধাটুকুই বোঝে।’’
আব্দুল গনি ও ষাটোর্ধ তাহসেনা বিবিরা অবশ্য জানাচ্ছেন, নোট বাতিলের সিদ্ধান্তের সময় ধানের দাম কিলোপ্রতি ১০ টাকায় কিনে ওই দামে অন্য জিনিস দিচ্ছিলাম। পরে ধানের দাম কমে ৭-৮ টাকা হয়। এত ধান জমে গিয়েছিল যে, তা আর বিক্রি না করে উপায় ছিল না।
আব্দুলের কথায়, ‘‘নগদ টাকা না থাকায় আমরাও মহাজনের থেকে জিনিস কিনতে পারছিলাম না। তখনই ধান নেওয়া বন্ধ করে ধারে জিনিস দেওয়া শুরু করলাম। টাকা ফেরত কবে পাব, এই উদ্বেগ ও অনিশ্চয়তা থেকে দামও কিছুটা বাড়াতে হয়েছিল। ভেবেছিলাম পরিস্থিতি শুধরে গেলে সব ঠিক হয়ে যাবে। কেনাবেচা চললে টাকা ফেরত পাব।’’ তবে নোটবন্দির সৌজন্যে একটা জিনিস এখনও চালু গ্রামে। তা হল, ধানের বদলে জিনিস নেওয়ার চল। হাতের কাছে থাকা কিলো দু’য়েক ধান নিয়ে গিয়ে সমমূল্যের কিছু কিনে নেওয়া।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy