অবসর: চলছে আইনজীবীদের কর্মবিরতি। সিউড়ি আদালত চত্বরে কাজের অপেক্ষায়। বৃহস্পতিবার। ছবি: তাপস বন্দ্যোপাধ্যায়
প্রায় ফাঁকা জেলা আদালত। বৃহস্পতিবার সকালে সেরেস্তাদারেদের একটি বেঞ্চে মাথায় ব্যান্ডেজ নিয়ে শুকনো মুখে বসে ছিলেন প্রৌঢ় রেণুপদ বাগদি। সাঁইথিয়া থানা এলাকার বাসিন্দা তিনি। তাঁর দাবি, পড়শির সঙ্গে জমি সংক্রান্ত বিবাদের জেরে মাথা ফেটেছে তাঁর। সাঁইথিয়া থানা অভিযোগ নেয়নি। তাই ছুটে এসেছিলেন জেলা আদালতের আইনজীবী ধরে পড়শির বিরুদ্ধে মামলা করবেন বলে। কিন্তু, হতাশ হতে হল ওই প্রৌঢ়কে। আইনজীবীরা যে কর্মবিরতি ডেকেছেন, জানাই ছিল না! এ দিন আদালত পক্সো মামলায় সাক্ষ্য দিতে এসেও ঘুরতে হল কীর্ণাহারের বিমান পালকে। কারণ সেই কর্মবিরতি।
হাওড়ায় আইনজীবী-পুলিশ গণ্ডগোলের পরেই সেই ২৫ এপ্রিল থেকে রাজ্য জুড়ে কর্মবিরতি পালন করছেন আইনজীবীরা। বীরভূম জেলা আদালতও তার ব্যতিক্রম নয়। প্রতিদিন শয়ে শয়ে বিচারপ্রার্থী ও তাঁদের পরিজনদের কোর্টে এসে খালি হাতেই ফিরতে হচ্ছে। এমনও হয়েছে, জামিন মঞ্জুর হয়ে গিয়েছে, অথচ প্রায় এক মাস ধরে জেলেই থাকতে হচ্ছে জামিনযোগ্য ধারায় ধৃত অভিযুক্তকেও। বৃহস্পতিবার সিউড়ি বার অ্যাসোসিয়েশনের সম্পাদক মৃত্যুঞ্জয় মুখোপাধ্যায় বলছেন, ‘‘রাজ্য বার কাউন্সিলের সিদ্ধান্তের একচুল বাইরে আমরা যেতে পারি না। সেই সিদ্ধান্ত মেনে কর্মবিরতি চলার কথা ২১ মে পর্যন্ত।’’
প্রতিবার গ্রীষ্মের এই সময়টায় মর্নিং কোর্ট বসে। সিউড়ি আদালতেও এখন সকালে কোর্ট বসছে নিয়মিত। কিন্তু অন্যান্য বছর এই সময়টায় আদালত চত্বরে এলে যে কর্মব্যস্ততার ছবি চোখে পড়ে, আইনজীবীদের কর্মবিরতির সৌজন্যে সেটা অমিল। আদালতে আসাযাওয়া করছেন আইনজীবী, ল-ক্লার্কেরা। আসছেন বিচারক, বিচারপ্রার্থীরা। কিন্তু কাজের কাজ কিচ্ছু হচ্ছে না। বিচারপ্রক্রিয়া চলতে থাকা মামলাগুলিতে শুধু অন্য তারিখ নির্দিষ্ট হচ্ছে। আর বিভিন্ন অভিযোগে গ্রেফতার হওয়া এবং সংশোধনাগার থেকে আসা অভিযুক্তেরা ফের সংশোধনাগারে ফেরত যাচ্ছেন। কারণ, জামিন করানোর জন্য উকিল মিলছে না!
সরকারি আইনজীবীদের একাংশই জানিয়েছেন, গত তিন সপ্তাহের মধ্যে এক জন মাত্র জামিন পেয়েছেন। তা-ও তিনি নিজের জামিনের পক্ষে সওয়াল করেছিলেন। বাকি অধিকাংশ অভিযুক্তের হয়ে জামিন করার কেউ নেই। কেউ নিজে জামিন চেয়ে আবেদন করে বিচারকের কাছে জামিন পেলেও জামিনদার খুঁজে বা বন্ড দিয়ে জামিন পাচ্ছেন না। ফলে সংশোধনাগার ভরে উঠছে। সিউড়ি জেলা সংশোধনগার সূত্রে জানা গিয়েছে, কর্মবিরতি শুরু হওয়ার আগে ৩৮০ জন বিচারাধীন বন্দি ছিলেন। সেই সংখ্যা বেড়ে ৪৬০-এ পৌঁছেছে। কারণ, যে বা যাঁরা একবার জেলে ঢুকছেন, আপাতত বের হওয়ার রাস্তা বন্ধ হয়ে গিয়েছে। আইনজীবীদের একাংশ বলছেন,
টানা তিন সপ্তাহ কর্মবিরতিতে যে চরম সমস্যা এবং অচলাবস্থা তৈরি হয়েছে, সেটা মানছেন জেলা আদালতের সরকারি আইনজীবীরা। বিচারপ্রার্থী ছাড়াও চরম অসুবিধায় রয়েছেন ল’ক্লার্ক, তরুণ আইনজীবী, জামিনদার সকলেই। কিন্তু কর্মবিরতি না ওঠা পর্যন্ত কোনও রাস্তা খোলা নেই। জেলার পাবলিক প্রসিকিউটর মলয় মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘‘কর্মবিরতির জেরে আদালতে কার্যত কোনও কাজই হচ্ছে না। কিন্তু আইনজীবীদদের উপর পুলিশের লাঠি চালানোর ঘটনায় রাজ্য বার কাউন্সিলের যে অবস্থান, সেটা অমান্য করা যাচ্ছে না, সম্মানজনক সমাধানসূত্র বের না হওয়া পর্যন্ত।’’ অ্যাডিশনাল পাবলিক প্রসিকিউটর সৈয়দ সমিদুল আলমের কথায়, ‘‘অবিলম্বে এই অচলাবস্থা থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। কিন্তু, সেটা কী ভাবে হবে, সেটা ঠিক করবেন রাজ্যে বার কাউন্সিল ও কলকাতা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি।’’
কর্মবিরতির ফলে আখেরে বিচারপ্রার্থীরাই নাকাল হচ্ছেন, তা মেনে নিচ্ছেন জেলা আদালতের আর এক আইনজীবী সোমনাথ মুখোপাধ্যায়। তাঁর বক্তব্য, ‘‘আইনজীবীদের নিগ্রহ ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে কর্মবিরতিকে সমর্থন জানিয়েও বলছি বিচারপ্রার্থীদের দিনের পর দিন হয়রানি রুখতে বিকল্প পথ নিয়ে ভাবা উচিত।’’ অন্য দিকে আইনজীবী কৃতিশ্রী ভট্টাচার্য ও অমিতাভ ঘোষেরা বলছেন, ‘‘জেলা আদালতের মোট ১৫টি কোর্ট থেকে প্রতিদিন মানুষ খালি হাতে ঘুরছেন। কিন্তু, সমস্যা মেটাতে ইতিবাচক পদক্ষেপ করা হচ্ছে, এমনটা এখনও মনে হয়নি। অথচ বর্তমান পরিস্থিতিতে সেটা ভীষণ প্রয়োজনীয়।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy