Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪

বাস চাই, তরজায় নেতারা

দুপুর গড়ালেই গাঁ উজিয়ে লোকজন সব তেরঙ্গা পতাকা নিয়ে জড়ো হবেন। কিন্তু অত বাস কোথায়! কলকাতায় বৃহস্পতিবার তৃণমূলের একুশের সভায় লোক নিয়ে যেতে বুধবার বাস পেতে হিমসিম অবস্থা গেল দলের বাঁকুড়া জেলার নেতাদের।

বাস দখলে রাখতে ভরসা দলের পতাকা। বাঁকুড়ায়।—নিজস্ব চিত্র

বাস দখলে রাখতে ভরসা দলের পতাকা। বাঁকুড়ায়।—নিজস্ব চিত্র

রাজদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়
বাঁকুড়া শেষ আপডেট: ২১ জুলাই ২০১৬ ০১:৫৪
Share: Save:

দুপুর গড়ালেই গাঁ উজিয়ে লোকজন সব তেরঙ্গা পতাকা নিয়ে জড়ো হবেন। কিন্তু অত বাস কোথায়! কলকাতায় বৃহস্পতিবার তৃণমূলের একুশের সভায় লোক নিয়ে যেতে বুধবার বাস পেতে হিমসিম অবস্থা গেল দলের বাঁকুড়া জেলার নেতাদের।

প্রতিটি ব্লকে বড়, মেজো, সেজো, ছোট বিভিন্ন নেতা। দলের বার্তা— একুশে সবাই কলকাতা চলো। এ বার আবার যেমন তেমন সমাবেশ নয়, রাজ্যজুড়ে বিপুল জয়ের পরে এটাই প্রথম দলের বড় সমাবেশ। কাজেই শহিদ দিবসের সভাস্থলে কে কত লোক বয়ে আনল সেটাই নেতাদের কাছে ‘প্রেস্টিজ ইস্যু’ হয়ে উঠেছে। বলা তো যায় না, ভিড় দেখিয়ে যদি দলের শীর্ষ নেতৃত্বের নজরে পড়া যায়।

এই অবস্থায় তৃণমূলের বহু নেতা ক’দিন ধরে বাস ধরার প্রতিযোগিতায় নেমে পড়েছেন। কেউ রাস্তায় বাস দেখলেই নগদ টাকা ধরিয়ে আগে ভাগে ‘বুকিং’ করে ফেলছিলেন। কেউ আবার বাস পেতে বাস মালিকদের উপর ক্রমাগত চাপ দেওয়ার কৌশল নিয়েছিলেন। এই প্রতিযোগিতার বাজারে নেতাদের সামাল দিতে শ্যাম রাখি না কুল তা বুঝে উঠতে পারছেন না বাস মালিকেরাও।

বুধবার সকাল থেকেই বাঁকুড়া বাসমালিক সমিতির সম্পাদক দীপক সুকুলের ফোন টানা ব্যস্ত ছিল। ঘণ্টা খানেকের চেষ্টায় তাঁকে ধরতেই দীপকবাবুর উত্তেজিত গলা— ‘‘বাস আর দেওয়া যাবে না!’’ গলা শুনে ভুল হয়েছে বুঝে বলেন, ‘‘ভাই বাস চেয়ে একের পর এক ফোন আসা শুরু হয়েছে ভোর থেকে। সবাই গুণে গুণে বাস নিচ্ছেন। কম পড়লেই তাঁদের গোঁসা— ‘অমুক নেতাকে অত বাস দিয়েছেন, আমাকে কেন কম’। তিনি জানান, জেলায় বাস সীমিত। ফলে সবাইকে চাহিদা অনুযায়ী বাস দেওয়া সম্ভব নয়। ফি বছরের সমস্যা। এ বার ভাবছি মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছেই আমরা সমস্যার কথা জানাব।’’

কিন্তু নেতাদের দমাবেন কী ভাবে? প্রতিযোগিতার হাওয়া আঁচ করে তাই শহিদ দিবসের কয়েক মাস আগেই বাস ‘বুক’ করতে পথে নেমেছিলেন তৃণমূল নেতারা। কেউ কেউ বাসের কনডাক্টরদের হাতে নগদ ১০০ টাকা গুঁজে দিয়ে নিশ্চিত বুকিং সেরে ফেলেছিলেন। কেউ আবার দৌড়েছেন বাস মালিকদের কাছে। কিন্তু ২০ জুলাইয়ের সকালে চাহিদা মতো বাস পাওয়া যাচ্ছে না জানতে পেরে কোনও কোনও নেতার আক্কেল গুড়ুম অবস্থা।

সভায় নিয়ে যেতে আগেভাগেই ৫০টি বাস ‘বুক’ করেছিলেন খাতড়ার আইএনটিটিইউসি নেতা সুবীর বরাট। কিন্তু তাঁর ‘বুক’ করা বাস এলাকার অন্য তৃণমূল নেতারা জোর করে ‘বুক’ করেছে বলে তাঁর কাছে খবর আসে। এরপরেই তিনি খাতড়া থানায় এ নিয়ে অভিযোগ করেন। সেই অভিযোগে নিজের বুক করা ৫০টি বাসের তালিকাও দিয়ে দেন। এ দিন সুবীরবাবুর আক্ষেপ, “থানার দ্বারস্থ হয়েও সব বাস আমি পেলাম না। এটাই আক্ষেপ।”

বাসমালিক ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন সূত্রে খবর, বাঁকুড়া-আরামবাগ রুটে চলা একটি বাস তৃণমূলের জেলা সভাপতি অরূপ খাঁয়ের জন্য বুক করা হয়েছিল। মঙ্গলবার রাতে সেই বাসটিকে কোতুলপুরের কিছু তৃণমূল কর্মী আটকে দেন। ওই বাসের মালিক কুন্তল দাস আলোচনা করেও বাস ছাড়াতে পারেননি। শেষে অন্য একটি বাস অরূপবাবুকে দেওয়া হয়েছে বলে জানা গিয়েছে। কুন্তলবাবু বলেন, “বারবার বোঝালাম আগাম বুকিং হয়ে গিয়েছে। তা সত্বেও কেউ কোনও কথা শুনতেই রাজি হল না।”

খাতড়া পঞ্চায়েত সমিতির সহ-সভাপতি জয়ন্ত মিত্র আরও সর্তক। তিনি জানাচ্ছেন, ২১ শে জুলাই উপলক্ষে তিনি দু’মাস আগে থেকে বাস বুক করতে নেমেছিলেন। তাঁর বুক করা বাসে কেউ যাতে ভাগ না বসাতে পারেন তাই বুক করার পরেই জঙ্গলমহল লেখা হলুদ স্টিকার সাঁটিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। এ দিন তিনি বলেন, “আমি ১০০ খানা বাস বুক করেছি। এ ছাড়া বেশ কিছু লরি ও ছোট গাড়িও রয়েছে। ২০ হাজার মানুষকে আমি নিয়ে যাব।” সভার একদিন আগের সন্ধ্যায় বুক করা ১০০টি বাস হাতেও পেয়ে গিয়েছেন তিনি। স্বাভাবিক ভাবেই তাই তাঁর আক্ষেপও নেই।

তবে মাথায় হাত পড়েছে খাতড়ার আর এক তৃণমূল নেতা তথা বাঁকুড়া জেলা পরিষদের কর্মাধ্যক্ষ শ্যামল সরকারের। হন্যে হয়ে মাস খানেক আগে থেকেই সভায় যাওয়ার জন্য বাস বুক করতে নেমেছিলেন তিনি। কিন্তু চাহিদা মতো বাস পাননি। শেষ পর্যন্ত ২৮টি বাস পেয়েছিলেন। এ দিন সন্ধ্যা পর্যন্ত বেশ কয়েকটি বাস হাতে আসেনি তাঁর। যা নিয়ে চিন্তার শেষ নেই। তিনি বলেন, “২৫ হাজার মানুষকে আমি নিয়ে যাব। পর্যাপ্ত বাস পেতে হন্যে হয়ে ঘুরেছি। শেষে মাত্র ২৮টি বাস পেলাম। তাও সবকটা বাস সন্ধ্যা পর্যন্ত আসেনি।’’

বুক করা বাস পেতে দলের স্মরণাপন্ন হতে হয়েছে তালড্যাংরা ব্লক তৃণমূল সভাপতি মনসারাম লায়েককে। তিনি বলেন, “আমার বুক করা দু’টি বাস জেলার অন্যান্য জায়গার তৃণমূল কর্মীরা আটকে দিয়েছিলেন। শেষে জেলা নেতৃত্বের হস্তক্ষেপে সমস্যা মেটে।’’

একই সমস্যায় বাঁকুড়ার যুব তৃণমূল সভাপতি শিবাজী বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি ৭৬টি বাস কলকাতায় নিয়ে যেতে বাস মালিকদের সঙ্গে চুক্তি করেছিলেন। কিন্তু এ দিন সকালেই তিনি জানতে পারেন, চাহিদা মতো বাস পাওয়া যাচ্ছে না। তিনি বলেন, “বাস না পেলে খুবই সমস্যায় পড়ে যাব। সকাল থেকে ঘন ঘন বাস মালিকদের ফোন করে অনুনয়-বিনয় করে চলেছি। আর কী করব?”

নেতাদের বাস ধরাধরির চক্করে এ বারও একুশের দিনভর পথে বেরিয়ে বাস না পেয়ে নাকাল হওয়ার আশঙ্কা থাকছেই। তার আভাস বুধবার সকাল থেকেই মিলেছে। এ দিন বাঁকুড়া- বিষ্ণুপুর, বাঁকুড়া- সোনামুখী, বাঁকুড়া– পুরুলিয়া রুটে হাতে গোনা বাস চলেছে। বাস না পেয়ে যাত্রীদের দীর্ঘক্ষণ বিভিন্ন বাসস্ট্যান্ডে যাত্রীদের অপেক্ষা করতে দেখা গিয়েছে। ফলে আজ বৃহস্পতিবার সকাল থেকে কী অপেক্ষা করছে, শঙ্কায় যাত্রীরা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

TMC 21stjuly politics
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE