অন্ধ্রের মাছই ভরসা।—ফাইল চিত্র
মাছের বাজারে ঢুকতেই সার দিয়ে বসে রয়েছেন জেলেনিরা। পিছনে রাখা ঘুনি জাল থেকে টুপ টুপ করে জল পড়ে রাস্তা অল্পবিস্তর কাদা। ম-ম করছে আঁশটে খোশবাই। সামনে তিড়িং বিড়িং করে লাফাচ্ছে কুচো চিংড়ি। নগদ মাত্র পাঁচ-সাত টাকা দিলেই কচুপাতায় মুড়ে তারই এক খাবলা সটান চলে আসবে আপনার হাতে। আর যদি মুখ চেনা থাকে, বাড়তি আরও দু’-চারটে ফাউ পেয়ে যাবেন। কচু পাতার পোশাক ছেড়ে ভাতের পাতে লাউ বা ঝিঙের ঘণ্ট থেকে উঁকি মারে সেই সমস্ত চিংড়ি। বাঙালির সন্তান থাকে মাছে ভাতে।
কিন্তু, এই ছবিটাই কিছু কাল হল বদলে গিয়েছে। গত কয়েক মাস ধরে বাঁকুড়া শহরের মাছ বাজারে জেলেনিদের দেখা মিলছে না। নিরামিষ লাউঘণ্ট দিয়ে ভাত মাখতে বসে দুপুরের বাতাস দীর্ঘনিঃশ্বাসে ভারি করে ফেলছেন শহরের বাসিন্দারা। বাজারে চিংড়ি রয়েছে বটে। কিন্তু সে সব চালানি। কিনতে হলে কিলোপ্রতি কড়ায় গণ্ডায় গুনে গুনে দিতে হবে ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা। শুধু চিংড়িই নয়, বাজারের পথ মাড়াচ্ছে না ভাল চুনো মাছ, মৌরলা, ট্যাংরা বা চারাপোনারাও।
জেলেনিরা সব গেলেন কোথায়? প্রশ্ন শুনেই খাপ্পা হয়ে গেলেন বাঁকুড়ার চকবাজারের মাছ ব্যবসায়ী পণ্ডা ধীবর। বলেন, “আরে মাছ কি আর গাছে ফলবে না কি মশাই? জেলার সব পুকুরই তো শুকিয়ে কাঠ। মাছ আনবে কোথা থেকে?’’ পণ্ডাবাবুর পাশেই মাছ সাজিয়ে বসেছিলেন কালোবুড়া ধীবর। তিনিও বলেন, “জেলায় ছোট-বড় কোনও মাছই মিলছে না। চালানি মাছের উপর সবাই নির্ভর করে আছেন। তাতেও চাহিদা মিটছে না।’’
এই পরিস্থিতিতে মাছের দামও চড়তে চড়তে প্রায় আকাশ ছোঁয়ার জোগাড়। ক্রেতারা জানান, রুই কাতলাও দিন দিন ধরা ছোঁয়ার বাইরে চলে যাচ্ছে। চালানি রুই গোটা বিকোচ্ছে কিলো প্রতি ১৫০ টাকা দরে। গোটা কিনলে কাতলার দাম পড়ছে ২০০ টাকা প্রতি কেজি। তাঁরা জানান, গত বছরও এই সময় গোটা রুই ১২০ টাকা এবং কাতলা ১৫০ টাকা কিলো দরে বিক্রি হয়েছে। চারাপোনার দর ছিল ৭০ থেকে ৮০ টাকা। এ বার তারও দাম এসে ঠেকেছে ১৩০ থেকে ১৫০ টাকায়। এখন শহরের মাছের বাজারে একটি রসিকতা জনপ্রিয় হয়েছে। জনপ্রিয় বাংলা ছবির সংলাপের অনুকরণে লোকের মুখে মুখে ঘুরছে, ‘‘খাবি কি, দামেই মরে যাবি।’’
বাঁকুড়ার একটি আবাসনের বাসিন্দা পিঙ্কি চট্টোপাধ্যায় বলেন, “দিশি ছোট মাছ তো কত দিন চোখেই দেখিনি। যেটুকু আসছে সব চালানি। দামও বেশি।” বাঁকুড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক অরবিন্দ চট্টোপাধ্যায়ও মাছের বলেন, “বাজারে আজ মাস দেড়েক হতে চলল ভাল মাছ উঠছে না। চালানি মাছের স্বাদ বলে তো কিছুই নেই। ভাল করে দেখে না নিলে আবার পচা মাছও গছিয়ে দিচ্ছেন ব্যবসায়ীরা।’’ ক্রেতারা জানান, স্থানীয় জেলেরা বাজার থেকে উধাও হয়ে যাওয়ায় বেশি দাম দিয়ে পানসে চালানি মাছ কিনতে বাধ্য হচ্ছেন তাঁরা।
জেলা মৎস্য দফতরের এক আধিকারিক জানান, তীব্র গরমে ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়েছে জেলার মাছ চাষ। বেশিরভাগ ছোট পুকুর ও ডোবা শুকিয়ে গিয়েছে। বড় পুকুর বা ঝিলগুলিতে জল থাকলেও তা তলানিতে। জেলার সহ-মৎস্য অধিকর্তা অভিজিৎকুমার সাহা জানান, জলস্তর কমে যাওয়ার প্রভাব পড়ে মাছে বৃদ্ধির উপরে। ফলে অনেক আগেই ঝুঁকি না নিয়ে পুকুর থেকে মাছ তুলে ফেলছেন চাষিরা। এ দিকে শুকিয়ে যাওয়া জলাশয়ে নতুন করে মাছ ছাড়তেও পারছেন না কেউ। এই পরিস্থিতি চলতে থাকলে আগামী কয়েক মাসে মাছের জোগান আরও কমে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে বলে তিনি জানান।
অভিজিৎবাবু বলেন, “জেলার বাঁকুড়া সদর ও খাতড়া মহকুমার বিভিন্ন ব্লকেই বেশি পুকুর শুকিয়েছে। তুলনায় বিষ্ণুপুর মহকুমার পুকুরগুলিতে কিছু জল এখনও রয়েছে। কী ভাবে মাছের জোগান বাড়ানো যায় তা নিয়ে মৎস দফতর চিন্তা ভাবনা শুরু করেছে।”
উপ-মৎস্য অধিকর্তা (পশ্চিমাঞ্চল) সিদ্ধার্থ সরকার বলেন, “দীর্ঘ দিনের অনাবৃষ্টিতেই এই অবস্থা। তবে গত কয়েক দিন ধরেই দক্ষিণ বঙ্গের বিভিন্ন প্রান্তে বৃষ্টিপাত হচ্ছে। এটাই আশার কথা।’’ তাঁর আশ্বাস, পর্যাপ্ত পরিমান বৃষ্টি হলে মাছের ঝোলের বাটিও উপচে পড়বে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy