Advertisement
১৮ এপ্রিল ২০২৪

শহিদের অপেক্ষায় রাত জাগল মধুবনপুর

দড়ি থেকে ঝুলছে সারি সারি জাতীয় পতাকা। সবার হাতে হাতে ঘুরছে জাতীয় পতাকা। পুরো রাত গ্রামবাসী জেগে শুধু একজনের জন্যে। অপেক্ষার অবসান ঘটল মঙ্গলবার সকাল পৌনে ১১টায়। গ্রামে ফিরল বীর ছেলে অভিজিৎ নন্দী। তবে আগের মতো হেঁটে নয়, বিএসএফ জওয়ানদের কাঁধে, কফিনের ভিতর। চারদিক থেকে স্লোগান উঠল, অভিজিতের মৃত্যু হয়নি। তিনি অমর।

গ্রামে এল নিহত জওয়ান অভিজিৎ নন্দীর দেহ। —নিজস্ব চিত্র।

গ্রামে এল নিহত জওয়ান অভিজিৎ নন্দীর দেহ। —নিজস্ব চিত্র।

নিজস্ব সংবাদদাতা
সাঁতুড়ি শেষ আপডেট: ০৮ জুলাই ২০১৫ ০১:১৯
Share: Save:

দড়ি থেকে ঝুলছে সারি সারি জাতীয় পতাকা। সবার হাতে হাতে ঘুরছে জাতীয় পতাকা। পুরো রাত গ্রামবাসী জেগে শুধু একজনের জন্যে। অপেক্ষার অবসান ঘটল মঙ্গলবার সকাল পৌনে ১১টায়।

গ্রামে ফিরল বীর ছেলে অভিজিৎ নন্দী। তবে আগের মতো হেঁটে নয়, বিএসএফ জওয়ানদের কাঁধে, কফিনের ভিতর। চারদিক থেকে স্লোগান উঠল, অভিজিতের মৃত্যু হয়নি। তিনি অমর। তখন আবেগে কাঁপছে গোটা সাঁতুড়ির মধুবনপুর। জওয়ানরা থমথমে মুখে জাতীয় পতারায় মোড়া কফিন এনে নামিয়ে রাখলেন গ্রামের নবীন সঙ্ঘের সামনে। সঙ্গে সঙ্গে কফিনের উপরে কার্যত ভেঙে পড়ল গোটা গ্রাম। গ্রামবাসীদের সঙ্গেই নিহত বিএসএফ জওয়ান অভিজিতকে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে এসেছিলেন পুলিশ সুপার রূপেশ কুমার, রঘুনাথপুরের এসডিপিও পিনাকী দত্ত, রঘুনাথপুরের বিধায়ক পূর্ণচন্দ্র বাউরি। দুপুরের দিকে পূর্ণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় গ্রামের শ্মশানে শেষকৃত্য সম্পন্ন হল।

রবিবার কাশ্মীরের কূপওয়ারা জেলায় সীমান্তে পাকিস্তানি সেনার গুলি ও মর্টার বর্ষনে প্রাণ হারান পুরুলিয়ার সাঁতুড়ি থানার মধুবনপুর গ্রামের বাসিন্দা বিএসএফের ১১৯ নম্বর ব্যাটেলিয়নের জওয়ান অভিজিৎ নন্দী। রবিবার সন্ধ্যায় কাশ্মীর থেকে ফোনে ভা ই চিরঞ্জিতকে সেই মর্মান্তিক খবরটা দিয়েছিলেন বিএসএফের আধিকারিকরা। তখন থেকেই গ্রামের ফুটবল ও ক্রিকেট দলের একদা নিয়মিত খেলোয়াড়, দক্ষ সাঁতারু অভিজিতের দেহের জন্য অপেক্ষা শুরু হয়েছিল। প্রথমে বিএসএফের তরফে অভিজিতের পরিবারকে জানানো হয়েছিল সোমবার সন্ধ্যার দিকে দেহ পৌঁছবে গ্রামে। সেইমতো অপেক্ষায় ছিলেন তাঁর পরিবার-সহ গ্রামবাসী। রাতের দিকে তাঁর পরিবার জানতে পারে, মঙ্গলবার সকালে দেহ গ্রামে আসবে। ফলে গোটা রাত কার্যত জেগে দেহের অপেক্ষায় কাটিয়েছেন অভিজিতের পরিবার। আর তাঁদের পাশে রাত জেগেছে গোটা গ্রামই। রাতেই তৃণমূলের ব্লক সভাপতি রামপ্রসাদ চক্রবর্তীকে সাথে নিয়ে গ্রামে যান স্থানীয় তৃণমূল বিধায়ক পূর্ণচন্দ্র বাউরি। মৃত জওয়ানের পরিবারকে তাঁরা জানান, শেষকৃত্যের খরচ বহন করবে পঞ্চায়েত। অভিজিতের ভাই চিরঞ্জিত নন্দী ও জেঠতুতো দাদা আশিস নন্দীর কথায়, ‘‘রবিবার সন্ধ্যায় খবরটা আসার পর থেকেই বিনিদ্র রাত কাটিয়েছি আমরা। পাশে পেয়েছি পুরো গ্রামকে।’’


নিহত বিএসএফ জওয়ান অভিজিৎ নন্দীর কফিনের সামনে শোকার্ত ভাই চিরঞ্জীব।

শুধু মধুবনপুরই নয়, এ দিন অভিজিতের শেষকৃত্যে সামিল হয়েছিল মুরাডি, কোটালডি, রামচন্দ্রপুর, ভস্কো, কোটালডি মুরুলিয়া সহ আট-দশটি গ্রামের বাসিন্দারা। গ্রামের রাস্তায় জাতীয় পতাকায় ছয়লাপ। মোড়ে মোড়ে টাঙানো হয়েছে নিহত জওয়ানের ছবি। অভিজিতের দেহ নিয়ে বিএসএফের প্রায় ১৬ জন জওয়ান যখন গ্রামে ঢুকলেন, সেখানে তখন জাতীয় পতাকা হাতে অপেক্ষা করছিল অভিজিতের প্রথম স্কুল মধুবনপুর প্রাথমিক স্কুলের ক্ষুদে পড়ুয়ারা। তাদের মিছিলের পিছনে জওয়ানরা দেহ নিয়ে ঢোকে গ্রামের নবীন সঙ্ঘের ক্লাবঘরের সামনে। তখন শত শত কণ্ঠে স্লোগান ওঠে— ‘ভারতমাতার বীর সন্তান অভিজিৎ নন্দী অমর রহে’।

ছুটিতে গ্রামে এলেই যে ক্লাবে অভিজিৎ বেশিরভাগ সময় কাটত, সেই নবীন সঙ্ঘ থেকে বিএসএফের জওয়ানরা কাঁধে করে কফিন নিয়ে পৌঁছয় নামোপাড়ায় তাঁর বাড়িতে। সেখানে তখন ছেলের দেহ গ্রামে আসার খবর পেয়ে আবার জ্ঞান হারিয়েছেন মা ঝর্নাদেবী। বাড়ির বাইরে পড়শিদের কাঁধে ভর দিয়ে কোনওরকমে দাঁড়িয়ে ছিলেন বাবা মধুসূদনবাবু। কফিনেরর পিছনের বাঁধভাঙ্গা ভিড়টা তখন পৌঁছে গিয়েছে অভিজিতের বাড়িতে। সঙ্কীর্ণ গলিতে ভিড় সামলাতে বাড়ির সদর দরজা বন্ধ করে কোনও রকমে বাড়ির ভিতরে কফিন ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। পরে দেহ নিয়ে যাওয়া হয় গ্রামের প্রান্তে শ্মশানে। সেখানে গান স্যালুট দেন বিএসএফের জওয়ান ও রাজ্য পুলিশের কর্মীরা।

এ দিকে কোনওমতে অশক্ত শরীরটাকে টেনে আত্মীয়দের সাথে শ্মশানে আসতে দেখা যায় মধুসূদনবাবুকে। চিতায় তখন শোয়ানো হয়েছে অভিজিতের নিথর গুলিবিদ্ধ দেহ। তাঁকেই ছেলের মুখাগ্নি করতে হবে শুনে নিজেকে আর ধরে রাখতে পারেননি বৃদ্ধ মধুসূদনবাবু। আত্মীয়দের কাঁধে ভর করে কোনও মতে চিতায় আগুন দিয়েই চিতার পাশে মাথায় হাত দিয়ে অঝোরো কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি। অভিজিতের দেহ যে জাতীয় পতাকা দিয়ে মোড়া ছিল, তা মধুসূদনবাবুর হাতে তুলে দেন বিএসএফের এক আধিকারিক। মধুসূদনবাবুকে ওই বিএসএফের আধিকারিক বলেন, ‘‘দেশ রক্ষার্থে শহিদ হয়েছে আপনার ছেলে। এটা বিরল সম্মান। তারই স্মারক হিসাবে জাতীয় পতাকা আপনার হাতে দেওয়া হচ্ছে।” সকাল থেকেই মুখ ভার ছিল আকাশের। ঝিরঝিরে বৃষ্টির মধ্যে জ্বলন্ত চিতার সামনে তখন অঝোর কান্নায় ভেঙে পড়েছে মধুবনপুর।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE