প্রাক্তন পুরপ্রধানের অস্বাভাবিক মৃত্যুর পিছনে কী রহস্য রয়েছে জানতে চাইছে রঘুনাথপুর।
শনিবার সন্ধ্যায় বাঁকুড়া রাস্তার পাশের শ্মশানে রঘুনাথপুরের প্রাক্তন পুরপ্রধান গৌতম মুখোপাধ্যায়ের শেষকৃত্য সম্পন্ন করা হয়। সেখানে যোগ দিতে যাওয়া মানুষজনের নিজেদের মধ্যে আলোচনায় বার বার ঘুরে ফিরে উঠেছে এই প্রসঙ্গ। বিশেষত স্নান বা প্রাকৃতিক কাজে কখনও পুকুরে না যাওয়া গৌতমবাবুর দেহ কী ভাবে পুকুরের জলে ভেসে উঠল, তা নিয়ে অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন।
এই ধরনের বেশ কিছু প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে শহর জুড়ে। শহরবাসীর মতোই গৌতমবাবুর পরিবারও চাইছেন, এই মৃত্যুর পূর্ণাঙ্গ তদন্ত করুক পুলিশ। তবে পুলিশের একটি সূত্রের খবর, শনিবার ময়নাতদন্তের পরে চিকিৎসকের কাছে প্রাথমিক ভাবে মৃত্যুর কারণ জানতে চাওয়া হয়েছিল। তাতে জানা গিয়েছে, জলে ডুবে মৃত্যু হয়েছে গৌতমবাবুর। প্রাথমিক ভাবে দেহে এমন কোনও আঘাতের চিহ্ন মেলেনি, যাতে মনে হতে পারে তাঁকে খুন করে জলে ফেলে দেওয়া হয়েছিল। জেলা পুলিশের এক পদস্থ কর্তা জানান, এই ধরনের ঘটনায় মৃতের পরিবার সরাসরি কারও বিরুদ্ধে খুনের অভিযোগ দায়ের করলে খুনের মামলা দায়ের করে তদন্ত শুরু করা হয়। এ ছাড়া ময়নাতদন্তের প্রাথমিক রিপোর্টে খুনের সম্ভবনা থাকলে সেই মতো স্বতঃপ্রণোদিত ভাবে পুলিশই মামলা করে তদন্ত শুরু করে। কিন্তু গৌতমবাবুর ক্ষেত্রে দু’টি বিষয়ের কোনওটাই হয়নি। তাই আপাতত ময়নাতদন্তের পূর্ণাঙ্গ রিপোর্টের জন্য অপেক্ষা করছে পুলিশ।
গৌতমবাবুর ছেলে দেবব্রত মুখোপাধ্যায় রবিবার বলেন, ‘‘বাবার মৃত্যুর পিছনে কী রহস্য রয়েছে তা আমরাও জানতে চাই। কিন্তু কী ভাবে বাবার মৃত্যু হল তা জানতে ময়নাতদন্তের পূর্ণাঙ্গ রিপোর্টের জন্য অপেক্ষা করা ছাড়া আমাদের কোনও উপায় নেই।” বস্তুত এলাকায় অত্যন্ত জনপ্রিয় গৌতমবাবুর সাথে কারও শত্রুতা বা বিবাদের ঘটনা শোনেননি বলে জানিয়েছিলেন তাঁর স্ত্রী কবিতাদেবী। তাই এখনই পুলিশের কাছে কারও বিরুদ্ধে সরাসরি খুনের অভিযোগ দায়ের করার পথে যেতে চাইছেন না তাঁরা।
বৃহস্পতিবার রাত থেকে নিখোঁজ থাকার পরে শনিবার ভোরে রঘুনাথপুর শহরের ৪ নম্বর ওয়ার্ডের দত্তবাগান এলাকার বাড়ির অদূরে পোদ্দার পুকুর থেকে উদ্ধার হয় প্রাক্তন সিপিএম পুরপ্রধান গৌতম মুখোপাধ্যায়ের দেহ। তবে গত দু’বছর ধরে সিপিএমের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ ছিল না। পুলিশের দাবি, দীর্ঘক্ষণ জলে থাকার কারণে গৌতমবাবুর দেহে বিকৃতি শুরু হয়েছিল। তাই দেহের অবস্থা দেখে পুলিশ প্রাথমিক ভাবে মনে করছে, আনুমানিক বৃহস্পতিবার রাতেই জলে ডুবে মৃত্যু হয় তাঁর। জেলা পুলিশের এক পদস্থ কর্তার দাবি, গরমের সময়ে ৩০ ঘণ্টার বেশি সময় জলে ডুবে থাকায় দেহ বিকৃত হতে শুরু করছিল।
কিন্তু এ ক্ষেত্রে স্থানীয় বাসিন্দাদের একাংশের দাবি, রাতে কী কারণে পুকুরে যেতে হয়েছিল গৌতমবাবুকে তা খুঁজে বের করুক পুলিশ। বস্তুত শনিবারই বাসিন্দাদের একাংশ রঘুনাথপুর থানায় গিয়ে ওসির কাছে ঘটনার পূর্ণাঙ্গ তদন্তের দাবি জানিয়ে এসেছেন। তাঁদের কথায়, ‘‘গৌতমবাবুর মৃত্যুর কারণ হিসাবে প্রাথমিক ভাবে পাওয়া ময়নাতদন্তের তথ্য অনুযায়ী পুলিশ বলছে জলে ডুবে তাঁর মৃত্যু হয়েছে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে নিজে থেকে জলে ডুবে গেছেন, নাকি তাঁকে জলে ডুবিয়ে মারা হয়েছে তা পুলিশের খতিয়ে দেখা দরকার।”
ওই বাসিন্দাদের প্রশ্ন, বৃহস্পতিবার রাত ৯টা নাগাদ বাড়ি থেকে ৩০০ মিটার দূরে কয়েকজনের সাথে গল্প করে বাড়ি ফেরার রাস্তা ধরেছিলেন গৌতমবাবু। তারপরে এমন কী ঘটল যে তাঁকে বাড়ি না গিয়ে পুকুরে যেতে হয়েছিল?
তাঁর ঘনিষ্ঠজনেরা জানাচ্ছেন, ভাল সাঁতার জানলেও গৌতমবাবু পুকুরে স্নান করতে বা প্রাতঃকৃত্য করতে যেতেন না। তা ছাড়া, রাত ৯টা পর্যন্ত তিনি যে এলাকায় ছিলেন, সেখান থেকে তাঁর বাড়ি আগে পরে, পুকুর রয়েছে তারও পিছনে। প্রাতঃকৃত্যের প্রয়োজন হয়ে থাকলে তিনি বাড়ি না গিয়ে পুকুরে কেন যাবেন? এ ছাড়াও রাত ৯টা পর্যন্ত যে পোশাকে গৌতমবাবুকে এলাকায় ঘোরাফেরা করতে দেখা গিয়েছে, দেহ উদ্ধারের সময়ে তাঁর পরনে ভিন্ন পোশাক থাকায় মৃত্যু রহস্য আরও ঘনিভূত হয়েছে। তাঁর বাড়ির লোকেরা জানাচ্ছেন, তিনি সে রাতে বাড়ি ফেরেননি। তা হলে পোশাকটা বদলালেন কোথায়, তাও খতিয়ে দেখার দাবি তুলেছেন বাসিন্দারা।
এ দিকে শনিবার সন্ধ্যায় শ্মশানে গৌতমবাবুর সৎকারে ৫০০-র বেশি লোক জমায়েত হয়েছিল। এই ঘটনাই প্রমাণ করে রাজনীতি থেকে সরে এলেও এলাকায় তিনি কতটা জনপ্রিয় ছিলেন। পুরসভার শববাহী গাড়িতে পুরুলিয়া সদর হাসপাতাল থেকে ময়নাতদন্তের পরে তাঁর দেহ নিয়ে আসা হয় তাঁর ক্লাব নবীন সঙ্ঘে। সেখান থেকে দেহ নিয়ে যাওয়া হয় রঘুনাথপুর পুরভবনে। সেখানে মালা দিয়ে শ্রদ্ধা জানান পুরপ্রধান ভবেশ চট্টোপাধ্যায় ও উপপুরপ্রধান তরণী বাউরি প্রমুখ।
রবিবার ভবেশবাবু বলেন, ‘‘গৌতমবাবু কোন দল করতেন সেটা বড় কথা নয়, এলাকায় তাঁর পরিচিত ছিল সমাজসেবী হিসাবেই। ফলে তাঁর অস্বাভাবিক মৃত্যুর পিছনে কী রহস্য রয়েছে সেটা জানতে চাইছেন এলাকার বাসিন্দারা। আমরাও চাই ঘটনার পূর্ণাঙ্গ তদন্ত করুক পুলিশ।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy