Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪

মুখ থুবড়ে পড়েছে চালকল শিল্প

নীলমণির সঙ্গে পঞ্চকোট রাজাদের রাজধানী কাশীপুরে সরে গেলেও কেশরগড় নিজের মতো করেই পাল্টাতে থাকে। রাজধানী বদলে যাওয়ার অনেক পরে গড়ে উঠেছিল হুড়া নামের জনপদটি। হুড়ার ইতিহাস গবেষক বঙ্কিম চক্রবর্তীর কথায়, তখন এলাকাগুলি বিভক্ত ছিল বিভিন্ন পরগনায়।

ধান থেকে যে জনপদের নামের উৎপত্তি, সেই হুড়ায় চালকলের রমরমা এখন ইতিহাস। বন্ধ চালকল। ছবি: প্রদীপ মাহাতো।

ধান থেকে যে জনপদের নামের উৎপত্তি, সেই হুড়ায় চালকলের রমরমা এখন ইতিহাস। বন্ধ চালকল। ছবি: প্রদীপ মাহাতো।

প্রশান্ত পাল
হুড়া শেষ আপডেট: ২৪ অগস্ট ২০১৫ ০১:০০
Share: Save:

নীলমণির সঙ্গে পঞ্চকোট রাজাদের রাজধানী কাশীপুরে সরে গেলেও কেশরগড় নিজের মতো করেই পাল্টাতে থাকে। রাজধানী বদলে যাওয়ার অনেক পরে গড়ে উঠেছিল হুড়া নামের জনপদটি।

হুড়ার ইতিহাস গবেষক বঙ্কিম চক্রবর্তীর কথায়, তখন এলাকাগুলি বিভক্ত ছিল বিভিন্ন পরগনায়। এখন যা হুড়া ব্লক হিসেবে পরিচিত, সেই সময় ওই এলাকা তখন লধুড়কা পরগনার অধীনে ছিল। হুড়ার পূর্বে বিশপুরিয়া-রখেড়া এলাকাটি ছিল বাগদা পরগনার অধীনে। সে সময় আর পাঁচটা গণ্ডগ্রামের মতোই হুড়াও ছিল জঙ্গলঘেরা একটি ছোট্ট গ্রাম। সেই সময় ওই এলাকায় জনপদ বলতে ছিল মাগুড়িয়া গ্রাম। পুরুলিয়া রামকৃষ্ণ মিশন বিদ্যাপীঠের ইতিহাস বিষয়ের শিক্ষক শ্যমল মণ্ডলের মতে, ‘‘সাঁওতালি ভাষায় হুড়ু বা হোড়ে শব্দের অর্থ ধান। আর ঢাকা বাংলা অ্যাকাডেমি থেকে প্রকাশিত আঞ্চলিক অভিধান বলছে হুড়্যা শব্দের অর্থ খড় বা তুঁষ জাতীয় আবর্জনা। এই এলাকায় ধানের চাষ ভাল হতো। পাশাপাশি একাধিক আদিবাসী গ্রামও রয়েছে। হতে পারে হুড়া নামের উৎপত্তির পিছনে এই বিষয়গুলিই ছিল।’’

এলাকার প্রবীণ বাসিন্দারা জানাচ্ছেন, হুড়া জনপদটি স্বাধীনতার আগে গড়ে উঠেছিল চালকল শিল্পকে ঘিরেই। হুড়াকে ঘিরে থাকা শুকনিবাসা, মতিপুর, জবজবিগোড়া, কেন্দবনা, পালগাঁ, ফুফুন্দি, পোখুরিয়া, পাহাড়পুর, কালিয়াবাসার মতো ছোট ছোট জনপদগুলির কেন্দ্রস্থল হিসেবেই গড়ে উঠেছিল এই জনপদটি। প্রবীণ বাসিন্দাদের কথায়, হুড়ার বুক চিরে চলে যাওয়া সড়ক ও চালকল শিল্পকে ঘিরেই চল্লিশের দশকের আগে-পরে জনবসতি গড়ে উঠল হুড়ায়। ধীরে ধীরে একটি একটি করে গড়ে উঠতে লাগল চালকল। হুড়ার এক প্রবীণ বাসিন্দা কানন কুণ্ডু জানান, তাঁর ঠাকুরদা ১৯৪৬ সালে হুড়ায় এসে প্রথম চালকল চালু করেছিলেন। তারপর একের পর এক চালকল গড়ে উঠল এখানে। লাগোয়া বাঁকুড়ার ঝাঁটিপাহাড়িতে চালকল শিল্পের রমরমা থাকায় সেখান থেকেও কেউ কেউ হুড়ায় এসে বসতি গড়ে তোলেন। শুরু করেন ব্যবসা।

তিনি বলেন, ‘‘ঠাকুরদাদের কাছে শুনেছি, তখন হুড়ায় বিদ্যুৎ আসেনি। হ্যারিকেনই ছিল ভরসা। চুরি-ডাকাতিও লেগে থাকত। আজ যেখানে জাতীয় সড়ক, সেখানে তখন ছিল পাথুরে রাস্তা। সেই রাস্তা পুরুলিয়ার সঙ্গে সংযুক্ত ছিল। হাতে গোনা গোটা তিনেক বাস চলাচল করত। বাঁকুড়ার সঙ্গে যোগাযোগের পাথুরে রাস্তা ছিল বটে, কিন্তু বর্ষাকালে সেই যোগাযোগও বিচ্ছিন্ন হয়ে যেত। কারণ এই রাস্তায় দ্বারকেশ্বর নদী পড়ে। সেই নদীর উপরেও কোন সেতু ছিল না।’’

হুড়ার নিস্তরঙ্গ অর্থনীতিতে বদলের স্বাদ এনেছিল এই চালকলগুলিই। সেখানে কাজ পেলেন অগুণতি মানুষ। কাননবাবুর কথায়, ‘‘চালকলে প্রচুর মানুষ কাজ করতেন। আশপাশের শুকনিবাসা, পুরশুড়া, দরিয়াকাটা, হন্যাগোড়া, ঘানিবেড়া প্রভৃতি গ্রাম থেকে শ্রমিকেরা আসতেন। ভোররাত থেকে কাজ চলত। বয়লারে ধান সেদ্ধ হচ্ছে, চাতালে শুকোনো হচ্ছে, তারপর হলার মেশিনে ধান থেকে চাল তৈরি করা হচ্ছে। পঞ্চাশের বেশি শ্রমিক সরাসরি কাজ করতেন। তার বাইরেও লরি-ট্রাকে ধান নিয়ে আসা, বস্তা খালাস-সহ আরও নানা কাজ ছিল।’’

তখন পুরুলিয়া (তৎকালীন মানভূম) বিহারের অন্তর্গত ছিল। তাই হুড়ার ব্যবসায়িক কাজকর্ম চলত ধানবাদের সঙ্গে। হুড়ার বাসিন্দা সত্যদাস কুণ্ডু জানান, হুড়া জনপদ গড়ে ওঠার সময় থেকে তাঁদের পরিবার এখানকার বাসিন্দা। তখন এলাকায় বিদ্যুৎ ছিল না। তাঁর বাবা-সহ এলাকার কয়েকজন ১৯৬৬ সালে বিদ্যুৎ নিয়ে আসার জন্য উদ্যোগী হন। রাস্তায় কয়েকটি বাস চললেও বাসিন্দাদের যাতায়াতের মূল মাধ্যম ছিল গরুর গাড়ি।

তবে তারও আগে ১৯৫৩ সালে এই জনপদ ব্লক সদর হিসেবে গড়ে উঠেছিল। সেই জনপদের ভিত্তি বলতে ছিল কৃষি ভিত্তিক শিল্প। হুড়ার প্রাক্তন বিধায়ক তথা আমলাতোড়া গ্রামের প্রবীণ বাসিন্দা শতদল মাহাতোর কথায়, ‘‘চালকলকে ঘিরেই হুড়া জনপদের উত্থান। ব্যবসা-বাণিজ্যের সূত্র ধরেই আশপাশের বিভিন্ন গ্রাম থেকে আসা মানুষজন ব্লক সদরে বসতি তৈরি করেন।’’

কিন্তু বাণিজ্য বা শিল্পকে ঘিরে যে জনপদের গড়ে ওঠার ইতিহাস, কেমন আছে সেই শিল্প? যাঁরা চালকল শিল্পের সঙ্গে যুক্ত, তাঁরা বলছেন বর্তমানে এই শিল্প ধুঁকছে। শিল্প ধুঁকতে থাকায় কাজ হারিয়েছেন শ্রমিকেরাও। একদা যাঁরা চালকলগুলিতে কাজ করে দু’পয়সার মুখ দেখতেন, শিল্প ধুঁকতে থাকায় তাঁদেরও ফিরতে হয়েছে সেই দিনমজুরির কাজেই। কেন মুখ থুবড়ে পড়ল এখানকার চালকল শিল্প? কাননবাবুর কথায়, ‘‘মূলত সরকারের নীতির জন্যই এই দুর্দিন। এক কুইন্ট্যাল ধান থেকে ৬৮ কেজি চাল করতে হবে বলে সরকার নির্দেশ দিলেও, বাংলার অন্যত্র তা সম্ভব হতে পারে, কিন্তু পুরুলিয়ার ধানে তা সম্ভব নয়। পাশাপাশি সরকারকে বিধি মোতাবেক লেভির চাল দিতে হবে। এবং দিতে হবে ওই কুইন্ট্যাল প্রতি ৬৮ কেজির হিসেবেই। কিন্তু কখন তার দাম মিলবে তার কোনও নিশ্চয়তা নেই। এই দুইয়ের জাঁতাকলে পড়ে এবং সেই সঙ্গে আধুনিকীকরণের জন্য অর্থ ঢালায় ঝুঁকি থাকায় চালকল শিল্প ধুঁকছে।’’

যে শিল্পকে ঘিরে এই জনপদের জন্ম সেই শিল্পই আজ হুড়ায় বিপন্ন। ঘুরে দাঁড়াবার পথ কোথায়?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Rice mill kashipu shymal mandal huda hura
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE