Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

ভোটের আগে সেই গোঁজই ভয় শাসকের

রাজ্যে পালাবদলের পরে প্রথম পুরভোটে আজ শনিবার বাঁকুড়ার মানুষ তিনটি পুরসভায় ভোট দিতে যাচ্ছেন। বাঁকুড়া ও বিষ্ণুপুর পুরসভায় গত পাঁচ বছর আগে তৃণমূল ক্ষমতা পেলেও কেবলমাত্র সোনামুখী তারা দখল করতে পারেনি। কয়েকবার অনাস্থা আনার চেষ্টা করেও সফল হয়নি তৃণমূল। এ বার কি পুরবাসী শাসকদলকে সোনামুখীতে ফিরিয়ে আনবেন? বাঁকুড়া, বিষ্ণুপুরের ভবিষ্যতই বা কী? জানা যাবে আগামী মঙ্গলবার।

বিষ্ণুপুরের রাস্তায় চলছে পুলিশি টহল। ছবি: শুভ্র মিত্র।

বিষ্ণুপুরের রাস্তায় চলছে পুলিশি টহল। ছবি: শুভ্র মিত্র।

নিজস্ব সংবাদদাতা
বাঁকুড়া শেষ আপডেট: ২৫ এপ্রিল ২০১৫ ০২:০০
Share: Save:

রাজ্যে পালাবদলের পরে প্রথম পুরভোটে আজ শনিবার বাঁকুড়ার মানুষ তিনটি পুরসভায় ভোট দিতে যাচ্ছেন। বাঁকুড়া ও বিষ্ণুপুর পুরসভায় গত পাঁচ বছর আগে তৃণমূল ক্ষমতা পেলেও কেবলমাত্র সোনামুখী তারা দখল করতে পারেনি। কয়েকবার অনাস্থা আনার চেষ্টা করেও সফল হয়নি তৃণমূল। এ বার কি পুরবাসী শাসকদলকে সোনামুখীতে ফিরিয়ে আনবেন? বাঁকুড়া, বিষ্ণুপুরের ভবিষ্যতই বা কী? জানা যাবে আগামী মঙ্গলবার।

বাঁকুড়া: বাঁকুড়ার মানুষের মন পরিবর্তনশীল। তাই পুরবোর্ড কখনও বামেদের দখলে গিয়েছে তো পরের বার বামবিরোধীরা পুরসভার মসনদে বসেছে। একচেটিয়া আধিপত্য কোনও দলকেই সে ভাবে দেননি বাঁকুড়াবাসী। গত পুরভোটে ২৩টির মধ্যে ১২টি ওয়ার্ড জিতে এই পুরসভা বামেদের হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়েছিল তৃণমূল।

রাজ্যে পালাবদলের পর অন্যান্য জেলার মতো এই জেলাতেও একের পর এক নির্বাচনে ভরাডুবি হয়েছে বামেদের। সেখানে গত লোকসভা ভোটে প্রধান বিরোধী শক্তি হিসেবে এই পুরসভায় উঠে এসেছে বিজেপি। সাংগঠনিক ভাবে গেরুয়া শিবির দুর্বল হলেও বিজেপি হাওয়া পুরভোটেও কিছুটা চিন্তায় রেখেছে শাসকদল তৃণমূলকে। গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে জেরবার তৃণমূলের আর এক কাঁটা দলের বিক্ষুব্ধ নির্দল প্রার্থীরা। দলীয় প্রতীক পেলেও ওয়ার্ড পছন্দ না হওয়ায় নিজের খাস তালুক ৬ নম্বর ওয়ার্ড থেকে নির্দল হয়েই লড়াই করছেন বিদায়ী তৃণমূল কাউন্সিলর রেখা দাস রজক। যা চাপে রেখেছে এই ওয়ার্ডের তৃণমূল প্রার্থী শান্তি সিংহকে। হাড্ডাহাড্ডি লড়াই এখানে। আবার ৩, ১২, ২৪ নম্বর ওয়ার্ডে তৃণমূলের বিক্ষুব্ধরা গোঁজ প্রার্থী হয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছেন। দলের তরফে রেখাদেবী-সহ চারজনকে দল থেকে বহিষ্কার করা হলেও ওয়ার্ডগুলিতে এই গোঁজ প্রার্থীদের জনসংযোগ শাসক দলকে ভাবাচ্ছে। তাই নির্বাচনী সভায় এসে তৃণমূল সাংসদ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় থেকে শুভেন্দু অধিকারী প্রার্থীদের নাম নয়, শুধু প্রতীক দেখে ভোট দেওয়ার নির্দেশ দিয়ে গিয়েছেন। ফলে এই পুরসভার লড়াই চতুর্মুখী। তাই নিজেদের জমি ধরে রাখতে কালঘাম ছুটছে তৃণমূল কর্মীদের। অন্যদিকে লোকসভায় দেশজুড়ে যে মোদী হাওয়া বয়েছিল তার ঝাপটা লেগেছিল বাঁকুড়া পুরসভাতেও। ভোট প্রাপ্তির নিরিখে ২৩টি ওয়ার্ডের মধ্যে এই পুরসভায় ৪টি ওয়ার্ডে বিজেপি প্রথম স্থানে উঠে এসেছিল। ১৬টিতে দ্বিতীয় স্থানে। লোকসভার জনপ্রিয়তা ধরে রাখতে পারাটাই বিজেপির কাছে এখন চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। অন্যদিকে অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখে অন্তত বিরোধী হওয়ার লক্ষ নিয়েই লড়াইয়ে নামছে বামেরা।

শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি। বাঁকুড়ায় শুক্রবার।

বিষ্ণুপুর: দীর্ঘ বাম আমলে গোটা রাজ্যের রাজনৈতিক রং যখন লাল, তখনও এই মল্লরাজধানী বিষ্ণুপুর পুরসভা দখলে রেখেছিল কংগ্রেস। পরবর্তীকালে এই পুরসভার চেয়ারম্যান শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় তাঁর কাউন্সিলরদের নিয়ে তৃণমূলে যোগদান করেন। কংগ্রেসের পুরবোর্ড পাল্টে হয় তৃণমূলের। টানা পাঁচবার পুরপ্রধান থেকে শ্যামবাবু এ বারও নির্বাচনে দাঁড়িয়েছেন। এ বার তাঁর কাছে ছ’বারের পুরপ্রধান হওয়ার হাতছানি। রাজনৈতিক মহলের লোকজন এক কথায় মেনে নেন বিষ্ণুপুরের রাজনীতির নিয়ন্ত্রক শ্যামবাবুই। বিরোধী দলগুলি এতদিনেও তাঁর কোনও বিকল্প তৈরি করতে ব্যর্থ। বরং ক্রমশ শক্তি খর্ব হয়েছে বিরোধীদের। বিদায়ী পুরবোর্ডে ১৯টি ওয়ার্ডের মধ্যে মাত্র ৩টি আসন রয়েছে বিরোধী দল সিপিএমের। বাকি সব ক’টি আসনই তৃণমূলের দখলে। তবে এ বারের নির্বাচনের বৈশিষ্ট্য হল এখানেও কয়েক’টি ওয়ার্ডে শাসকদলের বিক্ষুদ্ধরা নির্দল হয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছেন। ওই গোঁজরাই কয়েকজন প্রার্থীর কাছে ‘চাপ’ হয়ে উঠেছেন। ১০ ও ১৯ নম্বর ওয়ার্ডে তৃণমূলের এই গোঁজ প্রার্থীদের জন্য শাসকদলের ভোট ব্যাঙ্ক ভাগাভাগি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তাই সে দিকে তাকিয়ে আশায় বুক বাঁধছেন বিরোধীরা।

গত লোকসভা ভোটে এই পুরসভাতেও ভোট বেড়েছিল বিজেপির। কিন্তু সংগঠন এতটাই দুর্বল গেরুয়া শিবিরের যে এ বার সব আসনে প্রার্থীই দিতে পারেনি তারা। কয়েক মাস আগেও এই পুরএলাকায় বিজেপির সঙ্গে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হবে বলে আশা করেছিল শহরবাসী। কিন্তু ১৩ নম্বর ওয়ার্ডে খোদ শ্যামবাবুর বিরুদ্ধে ও ৯ নম্বর ওয়ার্ডে বিগত পাঁচটি পুরবোর্ডের উপপুরপ্রধান বুদ্ধদেব মুখোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধেই প্রার্থী দিতে পারেনি বিজেপি। এ ছাড়া ১১ ও ১৯ নম্বর ওয়ার্ডেও পদ্মফুল প্রতীকের কোনও প্রার্থী নেই। লোকসভার সময় কিছু তৃণমূল কর্মীই বিজেপিতে নাম লিখিয়ে ছিল এই পুরসভায়। তবে উঁচুতলায় সাংগঠনিক দুর্বলতা দেখে তাঁরাও এখন তৃণমূলেই ফিরে এসেছেন। ৯ নম্বর ওয়ার্ডে প্রার্থী দিতে পারেনি বামেরাও। এহেন দুর্বল প্রতিপক্ষ শ্যামবাবুর জয়ের রথ থমকে দেবে এমন সম্ভাবনা কার্যত নেই বলেই মত রাজনৈতিক মহলের। তবে বোর্ড দখল করতে না পারলেও আসন কিছুটা বাড়বে বলে স্বপ্ন দেখছে বাম শিবির।

সোনামুখী: বিগত পরপর দু’টি পুরভোটে জয়লাভ করে সোনামুখী পুরসভার বোর্ড ধরে রেখেছে বামফ্রন্ট। তবে রাজ্যে পালাবদলের পরে এই প্রথমবার পুরনির্বাচন হতে চলেছে। গত পঞ্চায়েত ভোটে জেলা থেকেই কার্যত মুছে গিয়েছে বামেরা। তবে জেলা বাম নেতৃত্বের দাবি, সোনামুখী শহরে অত সহজে পুরবোর্ড দখল করা সম্ভব নয় শাসকদলের। এর মূল কারণ অবশ্যই তৃণমূলের গোষ্ঠী কোন্দল। সোনামুখী কেন্দ্রের বিধায়ক দীপালি সাহা ও পুরসভার বিরোধী দল নেতা সুরজিৎ মুখোপাধ্যায়ের গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব আগেও একাধিকবার প্রকাশ্যে এসেছে। বামবোর্ডের বিরুদ্ধে সুরজিতের আনা অনাস্থায় এক ভোটে জিতে গিয়েছিল বামেরা। দীপালি গোষ্ঠীর কাউন্সিলররা বামেদের দিকে ভোট দিয়েছে বলে অভিযোগ তুলেছিল সুরজিতের গোষ্ঠী। ফলে বোর্ড বামেদের হাতেই রয়ে গিয়েছিল।

এ বার পুরভোটেও দীপালি ও সুরজিতের দ্বন্দ্বের ছায়া পড়েছে। বিভিন্ন ওয়ার্ডে গোঁজ প্রার্থীর উপস্থিতিই তার জানান দিচ্ছে। ভোটের আগে থেকেই এই দু’জনের অনুগামীদের মধ্যে আলোচন শোনা গিয়েছে, কে পুরপ্রধান হবে তা নিয়ে। ফলে প্রচার পর্বেও গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের ছায়া দেখা গিয়েছে দুই দলের কর্মীদের মধ্যে। শোনা যাচ্ছে একপক্ষ অন্য পক্ষের জয়ের পথেও কাঁটা বেছানোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। বিভিন্ন ভাবে দু’পক্ষই তাঁদের গোঁজ প্রার্থীদের ভোট ব্যাঙ্ক ভরাতে উঠে পড়ে লেগেছে। অন্যদিকে ক্ষমতা ধরে রাখতে মরিয়া বাম শিবিরও। তৃণমূলের অন্তকলহকে কাজে লাগিয়ে নিজের ভোট ব্যাঙ্ক অটুট রাখতে মরিয়া তারাও। প্রতীক না দিয়ে বেশ কিছু ওয়ার্ডে নির্দলও দাঁড় করানো হয়েছে বাম বিরোধী ভোট টানতে। তবে তাদের জয়ের ক্ষেত্রে বড় বাধা হিসেবে তুলে ধরা হচ্ছে শাসক দলের সন্ত্রাসকেই। যদিও কোনও ভাবেই দমতে নারাজ বাম শিবির। প্রয়োজনে পাল্টা পেশিশক্তি প্রয়োগ হবে বলেও কানাঘুষো শোনা গিয়েছে বাম নেতাদের মুখে। লড়াই হাড্ডাহাড্ডিই হতে যাচ্ছে।

আশা-আকাঙ্খা নিয়েই পুরভোটে যাচ্ছেন তিন শহরের ভোটাররা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE