এ বছরেও কি সারদাপ্রসাদ কিস্কুর নামে চালু হওয়া পুরস্কার প্রাপকের নাম ঘোষিত হবে না?
কবির জন্মস্থান বোরো তো বটেই, সেই প্রশ্ন ঘুরছে জঙ্গলমহলের পশ্চিম মেদিনীপুর, বাঁকুড়ার মতো জেলাগুলিতেও। সাধারণত কবির জন্মদিন, ২ ফেব্রুয়ারির আগে পুরস্কার প্রাপকের নাম ঘোষণা করা হয়। তার পরে দু’মাসের বেশি সময় পেরিয়েছে। এখনও কিছুই স্থির হয়নি। অনেকের আশঙ্কা, তা হলে কি গত বছরের পুনরাবৃত্তি হবে এ বছরেও? এই প্রেক্ষাপটে সাঁওতালি সাহিত্যিক ও বুদ্ধিজীবী মহলে ক্ষোভ বাড়ছে।
সারদাপ্রসাদ কিস্কু স্মৃতি পুরস্কার সাঁওতালি লেখক সাহিত্যিকদের কাছে অন্যতম বড় পুরস্কার। সারদাপ্রসাদের (১৯২৯-১৯৯৬) প্রথম পরিচয় তিনি কবি। পুরুলিয়ায় ডাইন-বিরোধী আন্দোলনেও তাঁর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। বোরো থানার দাড়িকাডোবা গ্রামের বাসিন্দা ছিলেন। সারদাপ্রসাদ জাতীয় শিক্ষকও। তাঁর প্রচুর কবিতা বাংলায় অনুবাদ হয়েছে।
কিন্তু, তাঁর নামাঙ্কিত পুরস্কার নিয়ে গড়িমসি কেন?
উত্তরে নানা ব্যাখ্যা উঠে আসছে। সাঁওতালি সাহিত্য আকাদেমি এই পুরস্কার দেয়। আকাদেমির এক সদস্য জানান, ফি বছর পুরস্কারের জন্য আবেদন পত্র চাওয়া হয়। লেখক নিজে অথবা তাঁর হয়ে অন্য কেউ সাহিত্যচর্চার অনুলিপি জমা দিয়ে আবেদন করতে পারেন। তবে গড়িমসির প্রশ্নে অভিযোগের আঙুল এই আকাদেমির দিকেই। কেমন?
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক লেখকের কথায়, লেখকরা কোন হরফে লিখবেন এ নিয়ে নির্দেশিকা না থাকলেও অলচিকি হরফে প্রকাশিত রচনাকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়। এমন কয়েক জন প্রতিষ্ঠিত সাঁওতালি লেখক রয়েছেন, যাঁরা কয়েক দশক ধরে সাহিত্যচর্চা করে এলেও বাংলা হরফে লেখার জন্য পুরস্কারে তাঁদের নাম বিবেচনা করা হয় না। তাঁর মত, ‘‘শুধু অলচিকিতে লিখছেন এমন লেখক হাতে গোনা। ফলে পুরস্কার দিলে গেলে সমস্যা হবেই।’’ তাঁরা জুড়ছেন, ‘‘একাধিক লিপিতে কঙ্কণী সাহিত্যচর্চা হয়। কঙ্কণী সাহিত্য আকাদেমি সব হরফকে গুরুত্ব দিয়ে থাকেন।’’ সাঁওতালি বুদ্ধিজীবীদেরও একটা বড় অংশের মত, হরফ নয় সাহিত্যের গুণমান বিচার করেই পুরস্কার দেওয়া উচিত।
বোরো থানার জামতোড়িয়ায় (এখানে কবির আবক্ষ মূর্তি রয়েছে) প্রতি বছরের মতো এ বারও ২ ফেব্রুয়ারি সারদাপ্রসাদ স্মৃতি রক্ষা কমিটি ও জামতোড়িয়া খেরওয়াল গাঁওতার উদ্যোগে কবির জন্মদিন পালিত হয়েছে। স্মৃতি রক্ষা কমিটির সদস্য শিক্ষক সুব্রত বাস্কে চলতি বছরে সারদাপ্রসাদ পুরস্কার প্রাপকের নাম ঘোষণা না হওয়ায় হতাশা গোপন করেননি। এ বিষয়ে দ্রুত পদক্ষেপের আর্জি রাখছেন তিনি। পুরস্কার নিয়ে গড়িমসিতে হতাশ বান্দোয়ানের বাসিন্দা বিশিষ্ট সাহিত্যিক মহাদেব হাঁসদাও। সাহিত্যিক কলেন্দ্রনাথ মাণ্ডির কথায়, ‘‘আকাদেমিতে যে কি হচ্ছে, কিছুই বুঝছি না। সাঁওতালি লেখক, সাহিত্যিক মহলে সারদাপ্রসাদের বিশেষ স্থান রয়েছে। এই আবেগ বোঝা দরকার।’’
আগে সাঁওতালি সাহিত্য আকাদেমি অনগ্রসর শ্রেণি কল্যাণ দফতরের অধীনে ছিল। বর্তমানে তা আদিবাসী উন্নয়ন দফতরের অধীনে। আকাদেমির চেয়ারম্যান আদিবাসী উন্নয়ন দফতরের বিদায়ী মন্ত্রী সুকুমার হাঁসদা। তিনি বলেন, ‘‘এ বার বিজ্ঞাপন দিতে একটু দেরি হয়ে গিয়েছে। দ্রুত পুরস্কার দেওয়া হবে।’’ অন্য সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবীদের তোলা প্রসঙ্গ এড়িয়ে গিয়েছেন তিনি।
তবে বিতর্ক থামছে না এরপরেও। অনেকের অভিযোগ, এর মূলে রয়েছে ভোট-রাজনীতি। পুরস্কার নিয়ে সাঁওতাল সমাজে ক্ষোভ রয়েছে টের পেয়েই পুরস্কার প্রাপকের নাম চূড়ান্ত করতে আকাদেমিকে বিস্তর মাথা ঘামাতে হচ্ছে, মনে করছেন অনেকেই। তাঁরা মনে করিয়ে দিচ্ছেন, সাঁওতালি মাধ্যম স্কুলগুলিতে পর্যাপ্ত শিক্ষক না থাকা, পঠনপাঠন নিয়ে দীর্ঘ দিন ধরেই ক্ষোভ রয়েছে। নানা জায়গায় বিক্ষোভ কর্মসূচি, স্মারকলিপিও দেওয়া হয়।
কেউ কেউ আবার টিপ্পনি কাটছেন, ‘‘শুধু সাহিত্যিক হলেই তো হবে না! শাসকদলের নেক-নজরে থাকা সাহিত্যিক হতে হবে। একে অলচিকিকে প্রাধান্য দেওয়ার নিয়ম, তার উপর শাসক-ঘনিষ্ঠ সাহিত্যিক। গোল বেধেছে সেখানেই।’’ বর্তমান সরকারের আমলে জঙ্গলমহলের বর্ষীয়ান লোককবি ভবতোষ শতপথীর সরকারি ভাতা চার বছর বন্ধ থাকার উদাহরণও টানছেন তাঁরা।
তবে এ সব অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছেন সুকুমারবাবু। তিনি বলেন, ‘‘সাহিত্যকীর্তিকে মাথায় রেখেই পুরস্কার দেওয়া হয়েছে, ভবিষ্যতেও তেমনটা করা হবে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy