Advertisement
১৯ মার্চ ২০২৪

শিশুরা এসে ফিরে যায়, হাতির ভয়ে স্কুলে আসেন না মাস্টারমশাই

প্রতি দিন এসে তালাবন্ধ দেখে তারা ফিরে যাচ্ছে। ছবিটি বিষ্ণুপুর মহকুমা শহর থেকে ১২ কিলোমিটার দূরে বেলশুলিয়া গ্রাম পঞ্চায়েতের হাতগাড়া গ্রামের।

পড়া-নেই: স্কুলের সময়ে চলছে মাঠে খেলা। —নিজস্ব চিত্র।

পড়া-নেই: স্কুলের সময়ে চলছে মাঠে খেলা। —নিজস্ব চিত্র।

নিজস্ব সংবাদদাতা
বিষ্ণুপুর শেষ আপডেট: ৩১ অগস্ট ২০১৮ ০০:৩৯
Share: Save:

সাজানো স্কুল চত্বর। আলাদা আলাদা শ্রেণিকক্ষ, জলের ট্যাঙ্ক, খাবার জায়গা, রান্নাঘর, খেলার মাঠ। শাল, সেগুনের জঙ্গলে ঘেরা গ্রামে আসার জন্য মোরামের চওড়া রাস্তা। রাস্তা হাতি আছে কি না তা নিয়ে বন দফতর নিয়মিত মোবাইলে সতর্কবার্তা পাঠায়। তার পরেও স্কুলে শিক্ষক আসতে চান না। এক জন মাত্র শিক্ষক ফেব্রুয়ারিতে অবসর নেওয়ার পরে বন্ধ রয়েছে শিশুশিক্ষা কেন্দ্র। কিন্তু শিশুদের আসা বন্ধ নেই। প্রতি দিন এসে তালাবন্ধ দেখে তারা ফিরে যাচ্ছে। ছবিটি বিষ্ণুপুর মহকুমা শহর থেকে ১২ কিলোমিটার দূরে বেলশুলিয়া গ্রাম পঞ্চায়েতের হাতগাড়া গ্রামের।

স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, প্রায় পাঁচ মাস কেন্দ্রটি বন্ধ রয়েছে। ফলে শুধু পড়াশোনা নয়, মিড-ডে মিল থেকেও বঞ্চিত হচ্ছে প্রথম শ্রেণির শিবানি মান্ডি, দ্বিতীয় শ্রেণির ডলমুনি মুর্মু, চতুর্থ শ্রেণিরর প্রশান্ত মান্ডিরা। সোমবার শাল, সেগুনের জঙ্গলে ঘেরা হাতগাড়া গ্রামে গিয়ে দেখা গেল গ্রামের এক দল বাচ্চা মাঠ খেলে বেড়াচ্ছে। আর এক দল বন্ধ স্কুলের দরজার সামনে বসে। স্কুলের সামনে বাইক থামতেই ডলমুনি, প্রশান্ত, সোনালীরা জানতে চাইল, ‘‘কবে স্কুল খুলবে গো? আবার দুপুরের খাওয়া কবে পাওয়া যাবে?’’

গ্রামের রবিন মান্ডি, শ্রীধর মুর্মুরা জানান, চারদিকে জঙ্গল। এই গ্রামে ৪০টি পরিবারের বাস। ৩০টি আদিবাসী আর ১০টি লোহার পরিবার। প্রথম থে কে চতুর্থ শ্রেণি অবধি ২৬টি বাচ্চা ওই কেন্দ্রে পড়তো। কারও জমি নেই। দিনমজুর আর শালপাতা সংগ্রহই পেশা। গ্রামে একটিই পাকা ঘর। সেটিই স্কুলবাড়ি। প্রবীণ হারান মান্ডি জানান, ১৯৯৯ সালে দু’জন শিক্ষককে নিয়ে স্কুল শুরু হয়েছিল। কাছেই চাঁচর গ্রামের মৃণাল চক্রবর্তী ২০১২-এর জানুয়ারি মাসে অবসর নেওয়ার পরে পাশের বেলশুলিয়া গ্রামের সাধন মহাদণ্ড একাই সামলাছিলেন। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে তিনিও অবসর নেন। তার পর থেকেই স্কুলে তালা। কেউ পড়াতে আসে না। বন্ধ মিড-ডে মিলও। মামুনি মান্ডি, লক্ষ্মীমণি মান্ডিরা জানান, ভোরে জঙ্গলে শালপাতা তুলতে বেরিয়ে যান। বাচ্চারা স্কুল থাকলে নিশ্চিন্তে থাকতেন। এখন বাচ্চাগুলি গ্রামেই ঘুরে বেড়ায়। সব থেকে কাছের বাগডোবা আর বেনাবান্দি গ্রামের স্কুল রয়েছে। তবে তা পাঁচ থেকে ছ’কিলোমিটার দূরে। জঙ্গলের পথে বাচ্চাদের পাঠাতে চান না তাঁরা।

সমস্যার কথা স্বীকার করে বিষ্ণুপুর পঞ্চায়েত সমিতির প্রাক্তন শিক্ষা কর্মাধ্যক্ষ নূর মহম্মদ খান বলেন, ‘‘ওই শিশুশিক্ষা কেন্দ্রটি জঙ্গল ঘেরা গ্রামে। কেউ পড়াতে যেতে চান না। প্রশাসনের সব স্তরে জানান আছে। বাচ্চাগুলি লেখাপড়ার পাশাপাশি মিড-ডে মিল থেকেও বঞ্চিত। দুপুরের খাবারটা ওই জঙ্গলঘেরা দিনমজুর পরিবারগুলির কাছে খুব প্রয়োজনের।’’ এই গ্রামের শ্রীধর মুর্মু এবং কবিতা মুর্মু— এই দু’জন মাধ্যমিক পাশ করেছেন। তাঁরা বলেন, ‘‘ভয়ের কী আছে বুঝি না। সাজানো স্কুল চত্বর। আলাদা আলাদা শ্রেণিকক্ষ, জলের ট্যাঙ্ক, খাবার জায়গা, রান্নাঘর, খেলার মাঠ। বন্ধ থাকায় আগাছা জন্মেছে। বন দফতর পুরো বসতি ব্যাটারি ফেনসিং দিয়ে ঘিরে দিয়েছে হাতির উৎপাত থেকে গ্রামকে রক্ষা করতে। এখন গ্রাম লাগোয়া পিচ রাস্তা হয়েছে। এক কিলোমিটার ঘন জঙ্গল। কিন্তু মোরামের রাস্তাটাও বেশ চওড়া। বন দফতর নিয়মিত হাতি থাকার সতর্ক বার্তা প্রত্যেকের মোবাইলে সকালেই মেসেজ করে। তার পরেও ভয়ের কথা বলাটা অজুহাত ছাড়া কিছু নয়। এর ফলে গ্রামের এক ঝাঁক পড়ুয়ার মাঝপথে পড়াশোন বন্ধ হতে বসেছে।’’

বিষ্ণুপুর মহকুমাশাসক মানস মণ্ডল বলেন, ‘‘ স্কুল একদম বন্ধ হবে না। সমস্যা জানার পরে বিশেষ অনুমতি নিয়ে বাঁকুড়া জেলা সরকারি ওয়েবসাইটে বিজ্ঞপ্তি জারি হয়েছে। স্থানীয় অবসরপ্রাপ্ত প্রাইমারি, আপার প্রাইমারি, উচ্চ মাধ্যমিক স্কুল-শিক্ষকদের কাছ থেকে আবেদনপত্র চাওয়া হয়েছে। পয়লা সেপ্টেম্বর বিষ্ণুপুরের মহকুমা অফিসেই ইন্টারভিউ হবে।’’ কিন্তু এত দেরি হল কেন? এ প্রশ্নের সদুত্তর মেলেনি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Elephant Teacher Child Education Centre
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE