Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

ঘরে ফিরে এল একা শিবচরণ

সেই কোন ছোটবেলা থেকে শিবচরণ শীতের গোড়ায় বাবা-মায়ের হাত ধরে পাড়া থানার মহাদেবপুরে আসছে। এ বারও খেজুর রস সংগ্রহ করতে মহাদেবপুরে গিয়েছিলেন শিবচরণের বাবা কালীপদ চৌধুরী। সঙ্গে ছিলেন স্ত্রী খুশবু (২৫)।

শোকার্ত: ভেঙে পড়েছেন পরিজনেরা। শুক্রবার পাড়া ব্লকের মহাদেবপুরে। ছবি: সঙ্গীত নাগ

শোকার্ত: ভেঙে পড়েছেন পরিজনেরা। শুক্রবার পাড়া ব্লকের মহাদেবপুরে। ছবি: সঙ্গীত নাগ

শুভ্রপ্রকাশ মণ্ডল 
পাড়া শেষ আপডেট: ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ ০২:৩৮
Share: Save:

শীত ফুরলোই বাড়ি ফেরার কথা ছিল শিবচরণদের। মাটির চালাঘর, গ্রামের পথ-ঘাট তাকে বড্ড টানত। শুক্রবার সকালে সেই পথ ধরেই সে ফিরল কাশীপুরের ধতলায় নিজেদের বাড়িতে। কিন্তু, একা। মা ও দুই খুদে ভাই-বোন তখন পুরুলিয়া শহরের মর্গে। সেখানেই পড়ে দুই মাসি, মামা ও এক মাসতুতো বোনের দেহও। পুড়ে জখম হওয়া তার বাবা ভর্তি বাঁকুড়া মেডিক্যালে। বৃহস্পতিবারের রাত বছর দশেকের ওই বালকের জীবনটাকে ওলটপালট করে দিয়েছে।

সেই কোন ছোটবেলা থেকে শিবচরণ শীতের গোড়ায় বাবা-মায়ের হাত ধরে পাড়া থানার মহাদেবপুরে আসছে। এ বারও খেজুর রস সংগ্রহ করতে মহাদেবপুরে গিয়েছিলেন শিবচরণের বাবা কালীপদ চৌধুরী। সঙ্গে ছিলেন স্ত্রী খুশবু (২৫)। এনেছিলেন শিবচরণ এবং আরও দুই ছেলেমেয়ে গঙ্গা (৭) ও রাহুলকে (৫)। গ্রামের এক প্রান্তে খেজুর ও তালপাতা দিয়ে ঘেরা ছোট্ট ঝুপড়িতে কোনওরকমে মাথাগুঁজে থাকছিলেন তাঁরা। শীত ফুরলেই তাঁদের গ্রামে ফেরার কথা ছিল। কিন্তু, তা আর হল না।

বৃহস্পতিবার মুম্বই থেকে ছুটিতে বাড়ি এসেছিলেন কালীপদর শ্যালক সুনীল চৌধুরী (২৯)। পাড়া থানারই দশারডিতে তাঁর বাড়ি। দিদি-জামাইবাবুর সঙ্গে দেখা করতে বেরিয়ে পড়েন সে দিনই। সঙ্গে নিয়েছিলেন বোন প্রিয়াঙ্কা (১৫), দিদি গীতা (২৮) ও তার সন্তান রাধিকা (৫), রোহিত ও মোহিতকে।

মামা, মাসি ও মাসতুতো ভাই-বোনদের পেয়ে শিবচরণদের ঝুপড়িতে যেন খুশির চাঁদ নেমে এসেছিল বৃহস্পতিবার। সারাদিন হইহই করে, রাতে জমিয়ে খাওয়াদাওয়া করে ওরা শুতে গিয়েছিল। তিনটি শিশুকে নিয়ে শিবচরণের মা ও দুই মাসি ঝুপড়িতে শুয়েছিলেন। বাইরে বাবা ও মামার সঙ্গে শিবচরণ ও দুই মাসতুতো ভাই শুয়েছিল। গল্প করতে করতে কখন যেন চোখ বুজে এসেছিল তার। শিবচরণ ভেবেছিল, শুক্রবার সকালে সবাই মিলে আবার হুল্লোড়ে মাতবে। কিন্তু, তা আর হল না।

এ দিন সকালে ঠান্ডা হাওয়ায় ঠকঠক করে কাঁপছিল এক রত্তি শিবচরণ। ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে ছিল। কাল রাত পর্যন্ত যেখানে তাদের ঝুপড়িটা ছিল, সেটা পুড়ে ছাই হয়ে গিয়েছে। ঝুপড়ি থেকে একে একে তার মা, মাসি, মামা, ভাই-বোন-সহ সাত জনের দেহ বার করে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। কালো ত্রিপলে ঢেকে দেওয়া হয়েছে জায়গাটা। চারপাশে দড়ি দিয়ে ঘেরা হয়েছে।

কোনওরকমে সে বলে, ‘‘মা, ভাই-বোনকে নিয়ে ঝুপড়িটা পুড়ে গেল। গায়ে আগুন লেগে বাবা ছটফট করছিল। চোখের সামনে সব ঘটে গেল।’’ এক আত্মীয় তার হাত ধরেন। নিয়ে যান ধতলার বাড়িতে।

বিকালে গ্রামে ফেরে মৃত সাত জনের দেহ। সরাসরি নিয়ে যাওয়া হয় শ্মশানে। শূণ্যদৃষ্টিতে বসেছিলেন কালীপদর বাবা শঙ্কর চৌধুরী। কালীপদর ভাই মুকেশ চৌধুরীও ভাইয়ের মতোই কাশীপুরের নারায়ণগড়ে খেজুর রসের ব্যবসা করেন। তিনি বলেন, ‘‘খেজুর রসের মরসুম শেষ হয়ে এসেছিল। কয়েকদিন আগেই দাদার সঙ্গে কথা হয়েছিল। বলেছিল মরসুম শেষ হচ্ছে। এ বার বাড়ি ফিরবে। কিন্তু, ওরা যে এ ভাবে ফিরবে, ভাবিনি।’’

মর্মান্তিক এই ঘটনা শুনে এ দিন সকালেই ঘটনাস্থলে ছুটে যান জেলার মন্ত্রী শান্তিরাম মাহাতো। সরকারের তরফে তিনি মৃতদের পরিবারের পাশে থাকার আশ্বাস দেন। বলেন, ‘‘পুলিশ পূর্ণাঙ্গ তদন্ত করবে।’’ পাড়া পঞ্চায়েত সমিতির প্রাক্তন সভাপতি সীমা বাউরিদের জমিতেই ঝুপড়ি করে থাকছিলেন কালীপদরা। তিনি বলেন, ‘‘বড় পরিশ্রমী ছিল ওরা। কিন্তু, এমন পরিণতি হবে ভাবিনি।’’

রাতেই ঘটনাস্থলে যান বিডিও (পাড়া) অনিরুদ্ধ বন্দ্যোপাধ্যায় এবং ওসি বিশ্বজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়। এ দিন সকালে যান অতিরিক্ত জেলাশাসক (সাধারণ) মুফতি শামিম সওকত ও রঘুনাথপুর মহকুমার ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট সুদেষ্ণা দে মৈত্র। বিকালে শ্মশানে যান অতিরিক্ত পুলিশ সুপার চন্দ্রশেখর বর্ধন, এসডিপিও (রঘুনাথপুর) দুর্বার বন্দ্যোপাধ্যায় ও বিধায়ক স্বপন বেলথরিয়া।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Death Fire Raghunathpur
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE