Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

কৌতূহলের কেন্দ্রে সেই সোনামুখী

বিষ্ণুপুর ও বাঁকুড়ার তুলনায় তার নাম ডাক কম। শহর হিসেবেও তুলনায় আটপৌরে। কিন্তু, পুরভোটে এই সোনামুখীকে নিয়েই যাবতীয় টানাপড়েন শাসক ও বিরোধীদের মধ্যে। পুরভোটের আগে থেকেই তৃণমূল-সিপিএম কাজিয়া এবং বহিরাগতদের নিয়ে সরগরম থেকেছে এই পুর-শহর। আর আজ, মঙ্গলবার জেলার মানুষের এবং রাজনৈতিক দলগুলির কৌতূহলের যাবতীয় কেন্দ্রেও থাকবে এই সোনামুখী।

এক রেলিংয়ের শরিক। বিষ্ণুপুরে ছবিটি তুলেছেন শুভ্র মিত্র।

এক রেলিংয়ের শরিক। বিষ্ণুপুরে ছবিটি তুলেছেন শুভ্র মিত্র।

স্বপন বন্দ্যোপাধ্যায়
বিষ্ণুপুর শেষ আপডেট: ২৮ এপ্রিল ২০১৫ ০০:৫০
Share: Save:

বিষ্ণুপুর ও বাঁকুড়ার তুলনায় তার নাম ডাক কম। শহর হিসেবেও তুলনায় আটপৌরে। কিন্তু, পুরভোটে এই সোনামুখীকে নিয়েই যাবতীয় টানাপড়েন শাসক ও বিরোধীদের মধ্যে। পুরভোটের আগে থেকেই তৃণমূল-সিপিএম কাজিয়া এবং বহিরাগতদের নিয়ে সরগরম থেকেছে এই পুর-শহর। আর আজ, মঙ্গলবার জেলার মানুষের এবং রাজনৈতিক দলগুলির কৌতূহলের যাবতীয় কেন্দ্রেও থাকবে এই সোনামুখী।

প্রশ্ন একটাই, রাঢ়বঙ্গে সিপিএম তথা বামফ্রন্টের দখলে থাকা একমাত্র পুরসভা সোনামুখীর দখল কাদের হাতে যাবে। তৃণমূল কি পারবে সিপিএমের হাত থেকে বোর্ড ছিনিয়ে নিতে, নাকি প্রতিরোধের দাওয়াইয়ে শেষ অবধি পুরসভার ক্ষমতায় আসবে বামেরাই! ত্রিশঙ্কু ফল হওয়ার সম্ভাবনাও ঘরোয়া আলাপচারিতায় উড়িয়ে দিতে পারছেন না দু’দলের নেতাদের একাংশ। বস্তুত, শহরের ২২ হাজার ভোটারের মনের উপরেই এখন নির্ভর করছে যুযুধান দুই দলের যাবতীয় স্বপ্ন। কোন পক্ষ শেষ হাসি হাসবে, এখনও পর্যন্ত কোনও দলই সেই সমীকরণ মেলাতে পারেনি।

ঘটনা হল, পঞ্চায়েত ও লোকসভায় ভরাডুবির পরেও এই একটা জয়ই বদলে যেতে পারে দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া বামেদের চেহারাটা। অন্য দিকে, বোর্ড দখলের মরিয়া চেষ্টা সত্ত্বেও শেষ অবধি হারতে হলে তা অনেক প্রশ্নের মুখে ফেলবে জেলার তৃণমূল নেতৃত্বকে। কারণ, বামেদের হাত থেকে এই পুরবোর্ড ছিনিয়ে নিতে এ বার সর্বশক্তি দিয়ে এখানে ঝাঁপিয়েছিল তৃণমূল। বহিরাগতদের নিয়ে এসে ভোটে সন্ত্রাস করার চক্রান্তও শাসকদল করেছিল বলে বারবার অভিযোগ করেছেন বিরোধীরা। কিন্তু, ছক ভেস্তে দিয়েছে পুলিশ ও আম জনতা। ধরা পড়েছে বহিরাগতরা। মজুত বোমাগুলিও বস্তাবন্দি হয়ে পুলিশের হেফাজতে চলে গিয়েছে। এই পরিস্থিতিতে তীব্র হতাশা শাসক শিবিরে। রবিবারই যার পরিণাম দেখা গিয়েছে সোনামুখী থানায়। গত লোকসভা ভোটে ছাপ্পাভোট দেওয়ায় অভিযুক্ত সোনামুখীর বিধায়ক দীপালি সাহা (পুরভোটে তিনিও এই পুরসভার তৃণমূলের প্রার্থী) নিজের অনুগামীদের নিয়ে থানায় ঢুকে বিক্ষোভ দেখিয়েছেন।

যা দেখে বাম নেতাদের কটাক্ষ, “পায়ের তলার জমি সরে গিয়েছে। ভোটে হার নিশ্চিত জেনেই এত রাগ দীপালিদেবর।” জেতার বিষয়ে সামনে আত্মবিশ্বাসী দেখালেও ঠিক কতগুলি ওয়ার্ড তাঁর দল পাবে, তা নিয়ে কিন্তু নিশ্চিত নন দীপালিদেবীও। শুধু বলেছেন, “আমরাই বোর্ড গড়ব।” তৃণমূলের জেলা সভাপতি অরূপ খাঁ-ও জেলার বাকি দু’টি পুরসভা (বাঁকুড়া ও বিষ্ণুপুর) বিরোধী-শূন্য হবে বলে হুঙ্কার ছাড়লেও সোনামুখীর বেলায় তাঁর গলায় সেই আত্মবিশ্বাস কোথায়? দীপালিদেবীর মতো তিনিও শুধু বলছেন, “বোর্ড গড়ব।’’ আবার সিপিএমের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য অমিয় পাত্র দাবি করেছেন, “সোনামুখীতে ছিলাম, থাকব।’’

সোনামুখী চমক দিতে পারবে কিনা, জবাব মিলবে আজ।

অন্য দিকে, বিষ্ণুপুর তো দূর অস্ত, বাঁকুড়া নিয়েও খুব বেশি আশা করছে না বাম-শিবির। তাই নজর শুধু ওয়ার্ড সংখ্যা বাড়ানোর দিকে। বাঁকুড়া পুরসভায় বিরোধী দলগুলি ব্যস্ত ক’টি ওয়ার্ড আসতে চলেছে সেই অঙ্ক কষতে। জেলার এক সিপিএম নেতার দাবি, “বোর্ড গড়ার আশায় আমরা নেই। তবে, গোটা কতক ওয়ার্ডে অবশ্যই জিতব। আরও কয়েকটায় ভাল ফল হবে।’’ বিজেপি-ও একই জায়গায়। গত লোকসভা ভোটের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বাঁকুড়া পুর-এলাকায় চারটি ওয়ার্ডে বিজেপি এগিয়েছিল। এ বার হাওয়া তেমন নেই, জানিয়ে দিলেন জেলারই এক বিজেপি নেতা। তাঁর কথায়, “টেনেটুনে তিনটি ওয়ার্ড পেতে পারলেও বা কম কী!’’ দিনের শেষে অনেকটাই বরং আত্মবিশ্বাসী দেখিয়েছে নির্দল হয়ে দাঁড়ানো তৃণমূলের গোঁজ প্রার্থীদের। নিজের নিজের ওয়ার্ডে বাজিমাৎ করবেন বলে বিশ্বাসী ৩ নম্বর ওয়ার্ডের বিশ্বজিৎ কুণ্ডু, ৬ নম্বরের রেখা দাস রজক, ১২ নম্বরে জীতেন দাস, ২৪ নম্বরের রঞ্জিত মজুমদাররা। যদিও এই পুরসভা বিরোধী শুন্য হবে বলে দাবি করেছেন তৃণমূলের জেলা সভাপতি অরূপ খাঁ।

বিষ্ণুপুরে হিসাবটা আরও এক তরফা। বিরোধী দলের কোনও অভিযোগ ছাড়াই এ বার বিষ্ণুপুরের ১৯টি ওয়ার্ডে ভোটদান পর্ব শেষ হয়েছে। গতবার ১৬টি আসন পেয়ে বোর্ড গড়েছিল তৃণমূল। বামফ্রন্টের দখলে ছিল ৩টি। এ দিন পুরসভা ভবনে পায়ের উপর পা চাপিয়ে দলের সহকর্মীদের সঙ্গে আড্ডায় বিদায়ী পুরপ্রধান তথা রাজ্যের বস্ত্রমন্ত্রী শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের প্রত্যয়ী দাবি, “সিপিএম গতবার ১, ২ ও ১৬ নম্বর ওয়ার্ড জিতেছিল। বিজেপি, কংগ্রেস তো নয়ই। এ বার সিপিএমকেও আমরা শূন্যে নামিয়ে সব ক’টি আসনই দখল করব।”

শহরের পাঁচ বারের পুরপ্রধান শ্যামবাবু যে নিশ্চয়তার সুরে কথাগুলি বললেন, সে জোর পাওয়া গেল না সিপিএমের বিষ্ণুপুর জোনাল কমিটির সম্পাদক অনিল পণ্ডিতের গলায়। তাঁর কথায়, ‘‘ক’টা আসন পাবো জানি না। জনগণ যা রায় দেবেন, মাথা পেতে নেব।’’ তৃণমূল সব আসনে প্রার্থী দিলেও বামফ্রন্ট দুই নির্দলকে সমর্থন জানিয়ে এ বার লড়াই করেছে ১৮টি আসনে। ও দিকে, বিজেপি বিষ্ণুপুরে এ বারই প্রথম ১৫টি আসনে প্রার্থী দিয়েছে। দলের বিষ্ণুপুর সাংগঠনিক জেলা সভাপতি স্বপন ঘোষ বাসস্ট্যান্ড লাগোয়া নিজের দোকানে বসে দাবি করলেন, “তৃণমূলের ফানুস এ বার ফুটো হয়ে যাবে! লিখে নিন, ১০টি ওয়ার্ডে জিতে এ বার আমরাই বোর্ড গড়ব।’’ ওয়ার্ডের নম্বরও বলে দিলেন তিনি।

কংগ্রেসের হাল অবশ্য জেলার তিন পুরসভাতেই খুব খারাপ। এক সময়ের কংগ্রেসের শহর হিসেবে খ্যাত ছিল বিষ্ণুপুর। দলের জেলা সভাপতি শ্যামবাবু তৃণমূলে যোগ দেওয়ার পর এলাকার প্রায় সব নেতাই চলে যান তাঁর সঙ্গে। টিমটিম করে দলটাকে জাগিয়ে রেখেছেন বিষ্ণুপুর শহর কংগ্রেস সভাপতি উদয় চক্রবর্তী। ১৯টি আসনের মধ্যে প্রার্থী দিয়েছেন ১০টি আসনে। তিনিও জোরের সঙ্গে বললেন, “পুরনো চাল ভাতে বাড়ে। বিষ্ণুপুরবাসী আমাদের এখনও ভুলে যায়নি। আমরা আশাবাদী, কিছু আসনে অন্তত জয়ী হব।’’

তৃণমূলের জন্য গোঁজের কাঁটা অবশ্য রয়েছে ১০ ও ১৯ নম্বর ওয়ার্ডে। দলের টিকিট না পেয়ে সেখানে নির্দল হিসেবে দাঁড়িয়ে পড়েছিলেন দুই তৃণমূল কর্মী মিলন রক্ষিত ও রাজীবকান্তি রায়। দল তাঁদের বহিষ্কার করলেও ওই দুই ওয়ার্ডে তৃণমূলের প্রতীকে দাঁড়ানো রবিলোচন দে ও অভিজিৎ সিংহকে রীতিমতো টক্কর দিয়েছেন তাঁরা। মিলন ও রাজীব এ দিন দাবি করলেন, তাঁরাই জিতবেন। একই ভাবে নিজের জয়ের ব্যাপারে আশাবাদী শহরের ২ নম্বর ওয়ার্ডের নির্দল প্রার্থী দয়াল পাত্র। তিনি বলেন, “তৃণমূলের বহিরাগত প্রার্থীকে চাইছেন না এলাকার বহু তৃণমূল কর্মী। এই ক্ষোভটা আমার কাছে সহায়ক হয়েছে।” তৃণমূল নেতৃত্ব অবশ্য জানিয়ে দিচ্ছেন, গোঁজ প্রার্থীতে প্রভাবিত হন না ভোটারেরা। তাঁরা দলীয় প্রার্থীকেই ভোট দিয়েছেন।

সহ প্রতিবেদন: রাজদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE