Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪

পাথুরে জীবনেই অভ্যস্ত পাঁচামি

দূর দূর পর্যন্ত পাথরের স্তূপ। গোটা এলাকাজুড়ে চারদিকে ছড়িয়ে রয়েছে ছোটবড় পাথরের চাঁই। কোথাও সেই পাথর ভেঙে সরু খাদের রাস্তা নেমে গিয়েছে। সে খাদের গভীরে তাকালে বুক কেঁপে ওঠে। ঠাওর হয় জেসিপি করে পাথর কাটার কাজ চলছে। কোথাও পাম্প লাগিয়ে জল মারার কাজ চলছে। কোথাও বা ডিনামাইটের শব্দে ছিটকে যাচ্ছে পাথরের টুকরো। কিছুক্ষণ পর পর খাদের সেই অতল থেকে উঠে আসছে পাথর বোঝাই ডাম্পার।

রোজগারের পথ, দূষণেরও কারণ। পাঁচামির কেন্দপাহাড়িতে পাথর ভাঙার কল।—নিজস্ব চিত্র।

রোজগারের পথ, দূষণেরও কারণ। পাঁচামির কেন্দপাহাড়িতে পাথর ভাঙার কল।—নিজস্ব চিত্র।

ভাস্করজ্যোতি মজুমদার
মহম্মদবাজার শেষ আপডেট: ২৭ মে ২০১৫ ০০:৪০
Share: Save:

দূর দূর পর্যন্ত পাথরের স্তূপ। গোটা এলাকাজুড়ে চারদিকে ছড়িয়ে রয়েছে ছোটবড় পাথরের চাঁই। কোথাও সেই পাথর ভেঙে সরু খাদের রাস্তা নেমে গিয়েছে। সে খাদের গভীরে তাকালে বুক কেঁপে ওঠে। ঠাওর হয় জেসিপি করে পাথর কাটার কাজ চলছে। কোথাও পাম্প লাগিয়ে জল মারার কাজ চলছে। কোথাও বা ডিনামাইটের শব্দে ছিটকে যাচ্ছে পাথরের টুকরো। কিছুক্ষণ পর পর খাদের সেই অতল থেকে উঠে আসছে পাথর বোঝাই ডাম্পার।

মহম্মহদবাজারের পাঁচামির এ সবই রোজের দৃশ্য। ঝাড়খণ্ড সীমান্ত লাগোয়া আদিবাসী অধ্যুষিত বিস্তীর্ণ মহম্মদবাজার এলাকা জুড়ে রয়েছে উৎকৃষ্ট মানের পাথর। সেই পাথরই শেষ পর্যন্ত হয়ে উঠল এখানকার মানুষের রুজি-রুটির প্রধান অবলম্বন। ৬০ দশকের শুরুতে পাঁচামিতে প্রথম পাথর খাদান বা পাথর উত্তোলন শুরু করেন পাঁচামির কাছাকাছি ভাঁড়কাটা গ্রামের বাসিন্দা নাজির হোসেন মল্লিক। কিন্তু সে সময় এলাকায় কোনও পাথর কলের প্রচলন ছিল না। ফলে বিভিন্ন মাপের পাথর ভাঙা নিয়ে সমস্যা তৈরি হয়। তখন এলাকার ‘চায়না ক্লে’-র শিল্পপতি প্যাটেল নগরের নিতাই চন্দ্র ঘোষ ১৯৬১-৬২ সালে প্যাটেল নগরে প্রথম পাথর ভাঙা কল বা ক্যাশার মেশিন স্থাপন করেন। এবং মেশিনটি কেনা হয়েছিল সুদূর কাশ্মীর থেকে।

সেই শুরু মহম্মদবাজার এলাকার পাঁচামি তথা জেলার প্রথম পাথর শিল্পের। তারপর থেকে উত্তরোত্তর বৃদ্ধি ঘটেছে এই শিল্পের। যদিও দূষণ সহ নানা অভিযোগে আদিবাসী আন্দোলনের কারণে মাঝে দু’ তিন বছর কিছুটা মুখ থুবড়ে পড়েছিল জেলার গর্বের এই শিল্প। যদিও পাথর শিল্পের চেয়েও অনেক প্রাচীন এই এলাকার লৌহ আকরিক শিল্প। বহু বছর আগেও রাজরাজাদের আমলে মহম্মদবাজারের বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে লৌহ আকরিক পাওয়া যেত। এবং তা থেকে কাটারি, তিরের ফলা, কৃষিকাজে ব্যবহৃত লাঙলের ফাল ইতাদি নানারকম লোহার সরঞ্জাম তৈরি হত। কাঁচা লোহার কারবারিদের ‘শাশা’ বলা হোত। এই ‘শাশা’দের সকলেই ছিলেন ইসলাম ধর্মের মানুষ। অন্যদিকে পাকা লোহার কারিগরদেরকে ‘মেহতর’ বলা হত। ‘মেহতর’-রা ছিলেন আবার সকলেই হিন্দু সম্প্রদায়ের। ১৭৬৫ সালে বীরভূমের লৌহখনি অঞ্চল ‘লোহা মহাল’ নামে একটি পৃথক মহালে পরিণত হয়। এই লোহা মহালের ইজারাদার ছাড়াও উৎপাদনের প্রায় সর্বস্তরে পাঠান রাজারা অল্প বিস্তর শুল্ক ধার্য করতেন।

অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথম পর্ব পর্যন্ত লোহার উৎপাদন ব্যবসা বেশ জমজমাট ছিল। কিন্তু অষ্টাদশ শতাব্দীর ষষ্ঠ দশকে চরম সংকট দেখা দেয়। কতকগুলি লৌহকেন্দ্র টিমটিম করে চলতে থাকে। এরই মধ্যে ১৭৭৪ সাল নাগাদ বিত্তশালী ইন্দ্রনারায়ণ শর্মার বীরভূমের লৌহশিল্পে প্রবেশ ফের আশার আলো জাগায় লৌহশিল্পে। ১৭৭৯ সালে ‘মেসার্স মট এন্ড ফার্কুহার’ দেউচায় কামান ও গোলাগুলি ঢালাইয়ের কারখানা স্থাপন করেন। নানা কারণে ১৭৮৯ সালে তিনি বীরভূমের কারবার তুলে দেন।

বলা যায় এভাবে চলতে থাকা বীরভূমের মহম্মদবাজারে ১৮৫৫ সালে কোলকাতার ‘মেসার্স ম্যাকে এ্যন্ড কোম্পানি’র ‘বীরভূম আয়রন ওয়ার্কস কোম্পানি’ জেলায় শিল্পপুঁজি ভিত্তিক প্রথম শিল্পোদ্যোগ। একই সঙ্গে আধুনিক কালের প্রথম শিল্প শ্রমিকের জন্ম হয় বীরভূমের ইতিহাসে। সাত বর্গমাইল বিস্তৃত লৌহখনি অঞ্চল ইজারা নিয়ে একচেটে অধিকার বলে তাঁরা দেশের সমস্ত কোটশাল নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। ধীরে ধীরে সাঁওতাল বিদ্রোহের উত্তাপ কমলে মহম্মদবাজারে গড়ে ওঠে বিশাল কারখানা। মাস মাইনের ভিত্তিতে লৌহ উৎপাদনে ইংরাজ কোম্পানির একচেটিয়া অধিকারের ফলে বেকার হয়ে পরেন শাশা, মেহতর, কামার, সালুই-সহ লৌহ শিল্পের সঙ্গে যুক্ত স্থানীয় মানুষ। নির্দিষ্ট মজুরীতে মহম্মদবাজার ও দেউচার কারখানায় এদের অনেকেরই কাজ জোটে।

কিন্তু লোকসানে চলতে থাকা মহম্মদবাজারের কারখানা কয়েক বছরের মধ্যেই বন্ধ করে দেয় ম্যাকে অ্যান্ড কোম্পানি। ১৮৭০ সাল পর্যন্ত কোনওরকমে টিকে থাকে দেউচা কারখানার একটি বৃহৎ চুল্লি। এর বছর চার পাঁচ পর ইংরাজ প্রতিষ্ঠান ‘বার্ন অ্যান্ড কোম্পানি’ লৌহ কারখানার কাজ শুরু করে। কিন্তু লোকসানের গন্ধ পেতেই বছর দশেকের মধ্যে কারবার তুলে নিয়ে কলকাতায় পাড়ি দেয়। এ সমস্ত তথ্য পাওয়া যায় রঞ্জন গুপ্তর লেখা ‘রাঢ়ের সমাজ, অর্থনীতি ও গণবিদ্রোহ’ বইয়ে।

বার্ন অ্যান্ড কোম্পানি এলাকা থেকে পাততাড়ি গুটিয়ে নেওয়ার পর দীর্ঘ ৫-৬ দশক এলাকায় কার্যত কোনও শিল্প ছিল না বললেই চলে। ৪০ এর দশকে প্যাটেলনগরে খড়ি মাটি বা চায়নাক্লে শিল্প গড়ে ওঠে। তারও বছর কুড়ি পর পাঁচামি মৌজার ৭৮ দাগে প্রথম পাথর খাদান শুরু করেন ‘পাঁচামি মাইন্স অনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি নাজির হোসেন মল্লিক। ৮২ বছরের নাজির হোসেন বাবু বলেন, ‘‘আমি যখন এখানে খাদান শুরু করি, তখন এই এলাকায় জনবসতি ছিল না বললেই চলে। এখনকার মত ডিনামাইট ফাটিয়ে খাদানের পাথর ভাঙার পদ্ধতিও জানা ছিল না। গাঁইতি, শাবল ইত্যাদি দিয়েই পাথর কাটা হত। রাস্তা নির্মাণের জন্য ছোট ছোট ট্রাকে সেই পাথর ঠিকেদাররা নিয়ে যেতেন। তখন ১০০ সি এফ টি পাথরের দাম ছিল ২২ টাকা।’’

পাথর খাদান শুরুর বছর দেড়েক পর প্যাটেলনগরে নিতাইবাবু ক্রাশার বসালে তাঁর ক্রাশারেই কাঁচা মাল সাপ্লাই দিতেন নাজির হোসেন। সেই স্মৃতি থেকে নাজিরসাহেব বলেন, ‘‘১৯৬৪ সালে পাঁচামিতে আমি ক্রাশার মেশিন বসাই। তারপর থেকে আস্তে আস্তে অনেকেই পাথর শিল্পের সঙ্গে যুক্ত হলেন।’’ ১৯৭৯ সালের ভয়াবহ বন্যার পর কার্যত পাঁচামি এলাকার পাথর শিল্পে জোয়ার আসে। ১৯৬০-৬৪ সালে ছিল একটি খাদান ও একটা পাথর কল। মাত্র বছর ২০-৩০ এর মধ্যে তা বেড়ে ৮০-১০০ খাদান ও ৪৫০-৫০০ পাথর কল স্থাপনই বলে দেয় পাঁচামি এলাকার পাথর শিল্পের রমরমা। কিন্তু ২০০৯ সালে একটি খাদানের বিস্ফোরণকে কেন্দ্র করে স্থানীয় আদিবাসীদের সঙ্গে দূষণ-সহ নানা কারণে পাথর শিল্পপতিদের বিরোধ তৈরি হয়। ওই বিরোধকে কেন্দ্র করে উভয় পক্ষের একাধিক ব্যক্তির মৃত্যু, আদিবাসীদের ঘরবাড়ি থেকে পাথর শিল্পের কল কারখানা, গাড়ি ও আসবাবপত্রে আগুন লাগানোর ঘটনা পর্যন্ত ঘটে। আদিবাসী আন্দোলনে থমকে যায় পাথর শিল্প।

সে বার প্রশাসনের সর্ব স্তরে বৈঠকের পর বৈঠক করেও কোনও সমাধান হয়নি। পাথর শিল্প বাঁচাতে শেষ পর্যন্ত তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য নিজেই এসেছিলেন মহম্মদবাজার ব্লক কার্যালয়ে। সেখানে আদিবাসী গাঁওতা নেতৃত্ব ও স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে বৈঠক করেন বুদ্ধবাবু। পাথর শিল্পের দূষণ রোধ-সহ এলাকা উন্নয়নের একগুচ্ছ প্রকল্প ঘোষণা করেন মুখ্যমন্ত্রী। তারপরও পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে বছর তিন সময় লেগে যায়।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE