Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

মাটি কোপাতে ফোস্কা কবুল, পাড়ায় সোনা ফলান গঙ্গামণি

বাবা ছিলেন সাঁওতালডিহির ভোজুডি কোল ওয়াশারির কর্মী। ২০০২ সালে বিয়ে হয়ে গঙ্গামণি আসেন পুরুলিয়ার পাড়া ব্লকের কালুহার গ্রামে। স্বামী অধীরচন্দ্র মাহাতো চাষি। সাড়ে সাত বিঘা পৈতৃক জমি রয়েছে।

সাজানো বাগানে। নিজস্ব চিত্র

সাজানো বাগানে। নিজস্ব চিত্র

শুভ্রপ্রকাশ মণ্ডল
পাড়া শেষ আপডেট: ০৩ অক্টোবর ২০১৯ ০০:৪৪
Share: Save:

রুক্ষ কাঁকুরে মাটি। গঙ্গামণির কথায়, ‘‘এক কোদাল কোপালেই পাথর উঠে আসে।” বিয়ের পরে সেই মাটিতেই আবাদ করে সোনা ফলাচ্ছেন তিনি। নিজেদের বাড়ির খাওয়া-পরার সমস্যা তো মিটেছেই। বছরে লক্ষাধিক টাকা আয় হয় এখন। ব্লকের সহকারী কৃষি অধিকর্তা দীনবন্ধু সর্দার বলছেন, ‘‘অদ্যম জেদকে সম্বল করে যে ভাবে গঙ্গামণি সফল হয়েছেন, সেই কথা আমরা ‘আত্মা’ প্রকল্পের অন্য মহিলা চাষিদের উৎসাহিত করতে শোনাই।”

বাবা ছিলেন সাঁওতালডিহির ভোজুডি কোল ওয়াশারির কর্মী। ২০০২ সালে বিয়ে হয়ে গঙ্গামণি আসেন পুরুলিয়ার পাড়া ব্লকের কালুহার গ্রামে। স্বামী অধীরচন্দ্র মাহাতো চাষি। সাড়ে সাত বিঘা পৈতৃক জমি রয়েছে। অনভ্যস্ত হাতে কোদাল তুলে নিয়ে স্বামীর সঙ্গেই মাঠে নামেন গঙ্গামণিও। অধীরবাবু বলেন, ‘‘বিয়ের আগে চাষের কিছুই জানত না ও। নিজের আগ্রহে খুঁটিনাটি শিখে উদয়াস্ত পরিশ্রম করেছে। একা হাতে পরিবারের হালটাই বদলে দিয়েছে ও।”

প্রথম দিকে মাটি কোপাতে কোপাতে হাতে ফোস্কা পড়ে যেত। কিন্তু জমির আয়েই সংসারের চাকা ঘোরে। তাই সে সবের রেয়াত করার জো ছিল না। দেড় কিলোমিটার দূর থেকে কাঁধে করে জল বয়ে এনে গাছে দিতেন আগে। এখন একটা মাঠকুয়ো খুঁড়িয়েছেন। তবে জলের টানাটানিটা পুরোদস্তুর মেটেনি। গঙ্গামণির কথায়, ‘‘এখন একটা সাইকেল কিনেছি। আগে সেটাও ছিল না। পায়ে হেঁটে পাড়া থেকে আনাজের বীজ আর ফলের চারা আনতাম।” যাওয়া-আসা মিলিয়ে হাঁটতে হত চল্লিশ কিলোমিটার। সকালে বেরিয়ে বিকেলে ফেরা।

গঙ্গামণির এই সমস্ত লড়াইয়ের সাক্ষী পুরুলিয়া কৃষি বিজ্ঞান কেন্দ্রের আধিকারিক মানস ভট্টাচার্য। তাঁদের কেন্দ্র থেকেই ফলের চারা আর আনাজের বীজ পেতেন মাহাতো দম্পতি। মানসবাবু বলেন, ‘‘কালুহারে গিয়ে দেখেছি, গরু বা বলদ না থাকায় স্বামী-স্ত্রী দু’জনে মিলে হাল টানছেন।” কৃষি বিজ্ঞান কেন্দ্র থেকে আধুনিক পদ্ধতিতে চাষের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু আধিকারিকের কথায়, ‘‘কেউ যদি কিছু করবেন বলে মনস্থির করে ফেলেন, তা হলে তাঁকে খুব একটা সাহায্য করার দরকার হয় না। গঙ্গামণির ক্ষেত্রে এই কথাটা ভীষণ ভাবে প্রযোজ্য।”

কালুহার গ্রামের এক একর রুক্ষ কাঁকুরে জমিতে এখন সবুজের সমারোহ। ভোর ৪টেয় ঘুম থেকে ওঠেন গঙ্গামণি। রাতে শুতে শুতে ১০টা। পুরো দিনটাই যায় চাষের কাজে। ফলিয়েছেন পাতি লেবু, মুসম্বি লেবু, গন্ধরাজ লেবু। চাষ করেছেন করলা, বাঁধাকপি, ফুলকপি, টম্যাটো। তৈরি করেছেন বিরাট পেয়ারার বাগান।

চাষ থেকে আয় বাড়তে এখন শুরু করেছেন ছাগল আর মুরগি পালন। আনাজ থেকে শুরু করে ফল বা মুরগি—সব বিক্রি করেন ঝাড়খণ্ডের চাষ এলাকায় গিয়ে। কালুহার থেকে দূরত্ব প্রায় পঁচিশ কিলোমিটার। কখনও স্বামী যান। কখনও গঙ্গামণি নিজে সাইকেল নিয়ে চলে যান হাটে। তাঁর কথায়, ‘‘চাষের হাটে ভাল দর পাওয়া যায়। তাই দূর হলেও ওখানেই যাই।’’

মানসবাবু জানাচ্ছেন, গঙ্গামণিকে দেখে আরও কুড়ি বিঘা জমিতে আনাজ চাষ শুরু হয়েছে কালুহার গ্রামে। প্রতি মাসে আট-দশ জন ওই দম্পতির জমিতে কাজ পান। গঙ্গামণি বলেন, ‘‘আগে টাকার অভাবে ছেলেটাকে একটা কম খরচের হস্টেলে রেখে পড়াতাম। এখন নিজের কাছে নিয়ে এসেছি। মালথোড় হাইস্কুলে ভর্তি হয়েছে।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Para Purulia Land Cultivation
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE