গ্রামে গ্রামে গিয়ে এ ভাবেই আনাজ কিনছে গোষ্ঠীগুলির সঙ্ঘ। নিজস্ব চিত্র
সারা দিন ইটভাটায় হাড়ভাঙা খেটেও পাড়া ব্লকের কুইরিপাড়ার রীতা কুইরি হাতে যা পেতেন, তাতে তাঁর ভাল ভাবে সংসার চলত না। একই অবস্থা ছিল ওই গ্রামেরই দিনমজুর সারথি কুইরিরও। তাঁদের সেই কষ্টের দিন একন অতীত। জৈব পদ্ধতিতে আনাজ চাষ তাঁদের দিন পাল্টে দিয়েছে। স্বনির্ভর গোষ্ঠীকে আনাজ বিক্রি করে এখন রীতা-সারথিরা মাসে গড়ে পাঁচ-ছয় হাজার টাকা করে আয় করছেন। বাড়িতে ফলানো আনাজেই চলছে নিজেদের সংসার। তাতে সংসারের খরচও কমে গিয়েছে। শুধু তাঁরাই নন, এই ভাবে বাড়িতে আনাজ ফলিয়ে সাবলম্বী হয়ে উঠেছেন পাড়া ব্লকের সাত-আটটি গ্রামের জনা পঞ্চাশ মহিলা।
এলাকার মহিলাদের কাছ থেকে আনাজ কিনে তাঁদের সাবলম্বী করার দিশা দেখিয়ে আসছে পাড়া ব্লকের স্বনির্ভর গোষ্ঠীগুলির ‘আনন্দময়ী সঙ্ঘ’। সেই কাজের স্বীকৃতিও মিলেছে। ইতিমধ্যেই মডেল সঙ্ঘের শিরোপা পেয়েছে তারা। তাদের কাজ স্বীকৃতি পেয়েছে জাতীয় স্তরেও।
পাড়া ব্লকের লাইভলিহুড প্রকল্পের প্রোজেক্ট ম্যানেজার মৌমিতা মাহাতো বলেন, ‘‘চলতি বছরের গোড়ায় দিল্লিতে কেন্দ্রীয় গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রক আনন্দময়ী সঙ্ঘকে ডেকেছিল। তাঁরা কী ভাবে গ্রামের মহিলাদের আর্থিক উন্নয়নে কাজ করছেন, সেখানে ওই সঙ্ঘের সদস্যেরা তা বিশদে তুলে ধরেন। আনন্দময়ী সঙ্ঘের কাজ সেরা হিসাবে স্থান পেয়েছে মন্ত্রকের প্রকাশিত পত্রিকায়।”
গ্রামে গ্রামে তৈরি হওয়া মহিলাদের স্বনির্ভর গোষ্ঠীগুলিকে নিয়েই গড়ে ওঠে সঙ্ঘ। মূলত স্বনির্ভর দলের মহিলাদের আর্থিক মানোন্নয়নেই কাজ করে এই সঙ্গ। পাড়া ব্লকের আনন্দময়ী সঙ্ঘের কাজে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন রঘুনাথপুর মহকুমা প্রশাসনের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট সুদেষ্ণা দে মৈত্র। তাঁর কথায়, ‘‘গ্রামগুলির মহিলাদের আর্থিক ভাবে স্বনির্ভর করার কাজ দক্ষতার সঙ্গে করেছে পাড়া ব্লকের ওই সঙ্গ। আরও কিছু কাজ ওই সঙ্ঘকে দিয়ে করানোর ব্যাপারে আমরা ইতিমধ্যেই কিছু পরিকল্পনা নিয়েছি।”
কী করছে আনন্দময়ী সঙ্ঘ? মৌমিতাদেবী জানান, প্রথমত সঙ্ঘের সদস্যারা গ্রামে গ্রামে ঘুরে স্বনির্ভর দলের সদস্যদের জৈব পদ্ধতিতে আনাজ চাষ এবং হাঁস, মুরগি, ছাগল প্রতিপালনের বিষয়ে উৎসাহী করছে। বিভিন্ন দফতরের সঙ্গে সঙ্ঘের মাধ্যমে ওই স্বনির্ভর দলের সদস্যদের যোগাযোগ করিয়ে দেওয়া হচ্ছে। সেখান থেকে স্বনির্ভর দলের মহিলারা যেমন প্রশিক্ষণ পাচ্ছেন, তেমনই পাচ্ছেন আনাজের বীজ এবং হাঁস, মুরগি, ছাগল ছানা।
পরের ধাপে স্বনির্ভর দলের সদস্যারা নিজেরাই বাড়িতে জৈব সার তৈরি করে তা ব্যবহার করে আনাজ ফলাচ্ছেন। অতীতে সেই আনাজ মহিলারা নিজেরাই বাজারে বিক্রি করতেন। সারা দিন বসে থেকে সব আনাজ বিক্রি হত না। এখন অবশ্য সেই আনাজের পুরোটাই কিনে নিচ্ছে আনন্দময়ী সঙ্ঘ। গ্রামে গ্রামে ঘুরে তৎক্ষণাৎ নগদ টাকা দিয়ে মহিলাদের কাছ থেকে আনাজ কিনে নেওয়া হচ্ছে। সেই আনাজই সঙ্ঘ বিক্রি করছে স্কুলে, অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রে এবং ব্লকের ক্যান্টিনে। পাড়া ব্লকের এই ক্যান্টিন আবার পরিচালনা করে আনন্দময়ী সঙ্ঘই। এ ছাড়াও বাজারে সঙ্ঘের একটি দোকান আছে। সেখান থেকেও স্বনির্ভর দলের সদস্যদের ফলানো আনাজ বিক্রি করা হয়।
আনন্দময়ী সঙ্ঘের দলনেত্রী তোতা মিশ্র জানাচ্ছেন, এ ভাবে কাজ করে একই সঙ্গে যেমন স্বনির্ভর দলের সদস্যদের আর্থিক মানোন্নয়ন হচ্ছে, তেমনই আর্থিক দিক দিয়ে লাভবান হচ্ছেন সঙ্ঘের সদস্যারাও। কেমন ভাবে? তোতা বলেন, ‘‘ব্লকের ক্যান্টিন চালানোর দায়িত্ব আমাদের উপরে। আগে বাজার থেকে আনাজ, ডিম, মাংস কিনে সেখানে রান্না করা হত। এখন আমরা সরাসরি মহিলাদের কাছ থেকে আনাজ, ডিম কিনে নিচ্ছি। একই সঙ্গে আনাজ, ডিম বিক্রি করছি স্কুলে ও অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রেও। ফলে স্বনির্ভর দলগুলির মহিলারা যেমন আর্থিক দিক দিয়ে লাভবান হচ্ছেন, তেমনই আমরাও লাভ করছি।”
গত বছরেই আড়াই লক্ষ টাকার মতো লাভ করেছে এই আনন্দময়ী সঙ্ঘ। সে তথ্য জানিয়ে তোতা বলেন, ‘‘নিছক লাভের আশায় এই কাজ নয়। সঙ্ঘের মূল উদ্দেশ্যই হচ্ছে স্বনির্ভর দলের সদস্যদের আর্থিক দিক দিয়ে আরও বেশি সাবলম্বী করে তোলা। আমরা এই কাজটাই করতে চেয়েছি।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy