Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪
education

বন্ধ স্কুল, ভরসা দিচ্ছে মাধবী দিদিমণির পাঠশালা

এই পরিস্থিতিতে বাঁকুড়ার ইন্দাসের আকুই গ্রামের ভৈরবতলা বস্তিতে বসছে মাধবী দিদিমণির পাঠশালা। গত দু’মাস ধরে জনা চল্লিশ শিশু পড়ছে সেখানে। পায়ের তলায় যেন মাটি ফিরে পেয়েছেন দিনমজুর পরিবারগুলি।

পাশে: মাধবী নন্দী ও পম্পা ঘোষ (বাঁ দিক থেকে)। নিজস্ব চিত্র

পাশে: মাধবী নন্দী ও পম্পা ঘোষ (বাঁ দিক থেকে)। নিজস্ব চিত্র

তারাশঙ্কর গুপ্ত
ইন্দাস শেষ আপডেট: ০৭ সেপ্টেম্বর ২০২০ ০১:৩২
Share: Save:

পায়রার খোপের মতো ছোট ঘরগুলিতে রোজ চলে বাঁচার লড়াই। তারই মধ্যে বাবা-মায়েরা নিয়ম করে সন্তানদের স্কুলে পাঠাচ্ছিলেন। কিন্তু করোনা এসে লেখাপড়া আরও নাগালের বাইরে নিয়ে চলে গিয়েছে। এই পরিস্থিতিতে বাঁকুড়ার ইন্দাসের আকুই গ্রামের ভৈরবতলা বস্তিতে বসছে মাধবী দিদিমণির পাঠশালা। গত দু’মাস ধরে জনা চল্লিশ শিশু পড়ছে সেখানে। পায়ের তলায় যেন মাটি ফিরে পেয়েছেন দিনমজুর পরিবারগুলি।
বাঁকুড়া এবং পূর্ব বর্ধমানের সীমানায় আকুই গ্রাম। সেখানকার ভৈরবতলা বস্তিতে প্রায় দেড়শো পরিবারের বসবাস। এলাকায় এক সময়ে পাঁচটি চালকল ছিল। গত দশ বছরে সব ক’টিই বন্ধ হয়ে গিয়েছে। নানা জেলা থেকে কাজের খোঁজে এসে কয়েক প্রজন্ম ধরে সেখানেই থিতু হয়ে গিয়েছে অনেক পরিবার। চালকল উঠে যাওয়ার পরে, এখন প্রায় সবার পেশা দিনমজুরি। এক জনের বাড়িতে অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্র চলে। প্রাথমিক স্কুল নেই। স্থানীয় বাসিন্দা সুহাগি হেমব্রম জানান, শিশুরা চার কিলোমিটার হেঁটে পূর্ব বর্ধমানের শিবমবাটি গ্রামের স্কুলে যায়। করোনার প্রাদুর্ভাব শুরু হওয়ায় স্কুল বন্ধ হয়েছে। বস্তির কাছে স্কুল চালাচ্ছিল একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা। বন্ধ সেটিও।
বছর পঁয়ত্রিশের মাধবী নন্দী থাকেন আকুই গ্রামে। ভৈরবতলা বস্তির সুরজ তামাং মে মাসের শেষে একটি দরকারে তাঁদের বাড়ি গিয়েছিলেন। তাঁর থেকেই শোনেন, সেখানকার ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার সমস্যার কথা। বাড়িতে পড়া দেখিয়ে দেওয়ার কেউ নেই। ক্ষমতা নেই টিউশন দেওয়ার। অনলাইন ক্লাসের জন্য স্মার্ট ফোন কেনা তো স্বপ্নের অতীত। মাধবী সিদ্ধান্ত নেন, নিজে গিয়ে পড়িয়ে আসবেন। সুরজের বাড়ির একফালি বারান্দায় শুরু হয় পাঠশালা। প্রথম থেকে চতুর্থ শ্রেণির চল্লিশ জন শিশুকে দু’টি দলে ভাগ করে নেওয়া হয়েছে। সপ্তাহে দু’দিন সকাল ৮টা থেকে ১০টা পর্যন্ত তাদের সমস্ত বিষয় পড়ানো হচ্ছে। এই কাজে মাধবী পাশে পেয়েছেন আকুই গ্রামেরই বধূ, বছর তেইশের পম্পা ঘোষকে।
মাধবী জানান, তাঁর বাপের বাড়ি পশ্চিম বর্ধমানের উখড়া গ্রামে। বাবা কাঠের কাজ করতেন। অভাবের সংসারে রীতিমতো লড়াই করে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত পড়েছেন। তাঁর কথায়, ‘‘টাকার অভাবে কারও পড়াশোনা হবে না, এটা মানতে পারি না। বিয়ের পরে এখানে এসে আগেও দুঃস্থ ছাত্রছাত্রীদের পড়িয়েছি।’’ মাধবীর স্বামী দীনবন্ধু নন্দী পেশায় চাষি। তিনি আকুই ১ পঞ্চায়েতের তৃণমূলের উপপ্রধান। দীনবন্ধুবাবু বলেন, ‘‘ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের জন্য কিছু করার তাগিদ মাধবীর বরাবরের। ও নিজে একজন নাট্যকর্মী। ওর ইচ্ছা রয়েছে বস্তির ছোটছোট ছেলেমেয়েদের নাটক শেখানোর।’’ পম্পা নিজে মাধ্যমিক পর্যন্ত পড়েছেন। স্বামী গাড়ির চালক। তাঁদের এক ছেলে, এক মেয়ে। মেয়ে স্থানীয় বালিকা বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ে। ছেলে অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রে যায়। অভাব সংসারে নিত্যসঙ্গী। পম্পা বলেন, ‘‘টাকার জন্য পড়া বন্ধ হয়ে যাওয়ার কষ্টটা বুঝি।’’
এখন বেশ কিছুটা নিশ্চিন্ত ভৈরবতলা বস্তির শিশুদের অভিভাবকেরা। তাঁদের মধ্যে আরতি সরেন বলেন, ‘‘সকালে দিনমজুরি করি। পুরো বর্ষাকালটা ঘরের মেঝের জল ছেঁচে শুতে যাই। ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা এখানে খুব সমস্যার। দিদিমণিরা নিজে থেকে আসছেন বলে ওরা কিছু শিখছে।’’ এই উদ্যোগের প্রশংসা করছেন বিডিও (ইন্দাস) মানসী ভদ্র চক্রবর্তী। তিনি বলেন, ‘‘বিষয়টি শুনেছি। আমি নিজে এক বার গিয়ে দেখে আসব।’’ আকুই ১ পঞ্চায়েতের তৃণমূলের প্রধান লক্ষ্মী সাঁতরা জানান, ওই গ্রামে একটি শিশুশিক্ষা কেন্দ্র গড়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। তিনি বলেন, ‘‘জমি নিয়ে সমস্যা ছিল। এক জন তিন কাঠা জমি দিয়েছেন।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

lockdown Education
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE