লাভপুরের ইন্দাস পঞ্চায়েত।
মানব পুতুল নাটকের আসরে ভিড় করেছেন গ্রামের মানুষ। পালা শেষ হতেই এগিয়ে এলেন দিনমজুর কল্যাণী দাস বৈরাগ্য, অনঙ্গ মঞ্জুরীরা। নাট্যদলের আবেদনে সাড়া দিয়ে বাড়িতে শৌচাগার তৈরির জন্য সরকারের কাছে অঙ্গীকারপত্রে একে একে স্বাক্ষর করলেন।
এ ভাবেই লোক বিনোদনকে মাধ্যম করে ‘নির্মল ভারত’ অভিযানে এই উদ্যোগ নিয়েছে বীরভূম জেলা প্রশাসন। যেখানে মানব পুতুল সেজে জেলার সাড়ে চারশো গ্রামকে বাড়িতে শৌচাগার থাকার প্রয়োজনীয়তা বোঝাচ্ছেন পরিচিত সাংস্কৃতিক সংস্থা ‘লাভপুর সংস্কৃতি বাহিনী’র সদস্যেরা। অতিরিক্ত জেলাশাসক (জেলা পরিষদ) বিধান রায় বলছেন, “বীরভূমে ৭ লক্ষ পরিবারের মধ্যে ৪ লক্ষ পরিবারের এখনও কোনও শৌচাগার নেই। সরকার বিনামূল্যে শৌচাগার বানিয়ে দিলেও মূলত কুসংস্কারের কারণেই বহু গ্রামের মানুষ তা তৈরি করতে চান না। এ ভাবে লোকনাট্যের মাধ্যমে আমরা সমাজের ওই অংশের কাছে পৌঁছে যেতে পারছি। অনেকেই শৌচাগার তৈরিতে সম্মত হচ্ছেন।”
সম্প্রতি জেলা প্রশাসনের করা একটি সমীক্ষা থেকে জানা গিয়েছে, জেলায় যে পরিমাণ মানুষ মোবাইল ফোন ব্যবহার করেন, সেই পরিমাণ শৌচাগারও নেই। দারিদ্রসীমার নীচে বসবাসকারী পরিবার তো বটেই, গ্রামের অনেকের বাড়িতেই মোটরবাইক, ফ্রিজ বা টিভি-ভিসিডি-র মতো বিনোদনের ব্যবস্থা থাকলেও কোনও শৌচাগার নেই। যার জন্য সব থেকে সমস্যায় পড়েন মেয়েরাই। অথচ তথ্য বলছে, বাড়িতে শৌচাগার না থাকার জন্য দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে মেয়েরা নির্যাতনের মুখে পড়ছেন। ভোর রাতে বাড়ি থেকে দূরে মাঠে প্রাকৃতিক কাজ সারতে গিয়ে অনেকেই ধর্ষণের শিকারও হয়েছেন। কিন্তু তারপরেও বিশেষ করে গ্রামের দিকে একটি অংশের বাসিন্দাদের এখনও শৌচাগারের প্রয়োজনীতা বোঝাতে ব্যর্থ প্রশাসন। সে দিক থেকে বীরভূম জেলা প্রশাসনের এই নতুন উদ্যোগ অনেকটাই কার্যকর হচ্ছে বলে প্রশাসনিক কর্তাদের দাবি।
প্রশাসন সূত্রে জানা গিয়েছে, কেন্দ্র সরকারের এই প্রকল্পে এখনও পর্যন্ত এপিএল তালিকাভুক্ত পরিবারদের মধ্যে ২,০৮,৪৯৭টি পাকা শৌচাগার নির্মাণ করা হয়েছে। যেখানে লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে ২,৯৯,৮৯৩টি। বিপিএল তালিকাভুক্ত পরিবারের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৩,৩৮,৯৮৯টি। সেখানে এখনও পর্যন্ত ৩,০৪,৬৭৪টি পরিবার শৌচাগার নির্মাণ করেছে। এপিএল-বিপিএল মিলিয়ে এই মুহূর্তে ৮০.০৭ শতাংশ লক্ষ্যমাত্রা পূর্ণ করেছে রাজ্য। বীরভূমেও সেই হার প্রায় এক ৮০.৩২%। বিধানবাবু জানান, শৌচাগার নির্মাণের ক্ষেত্রে খরচের পরিমাণ ১০,৯০০ টাকা। এর মধ্যে বেনিফিশিয়ারি কমিটি দেয় ৯০০ টাকা। বাকি দশ হাজার টাকা দেয় সরকারই। পাশাপাশি ১০০ দিনের কাজের মধ্যেও শৌচাগার নির্মাণকে আগেই যুক্ত করা হয়েছিল। এত সব আর্থিক সুবিধা থাকা সত্ত্বেও একটি অংশের মানুষের কাছে এই প্রকল্প কেন সাড়া পাচ্ছে না?
প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত আধিকারিকদের ব্যাখ্যা, কুসংস্কারের কারণে বহু গ্রামের মানুষ শৌচাগার করতে দিতে চান না। আর এতদিন পরেও ওই সব মানুষকে সচেতন করে তুলতে না পারার জন্য সরকারি ব্যর্থতার কথাও ওই আধিকারিকদের অনেকেই মেনে নিয়েছেন। শৌচাগার গড়তে প্রশাসন বাধা পেয়েছে, এমন একটি পঞ্চায়েত হল সিউড়ি ১ ব্লকের মল্লিকপুর পঞ্চায়েত। সেখানে প্রকল্পের বেহাল চিত্র দেখে জেলা প্রকল্প আধিকারিক লাভপুরের ‘বীরভূম সংস্কৃতি বাহিনী’র কর্ণধার উজ্জ্বল মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তারপরেই ওই সংস্থার সাহায্যে যে সব পঞ্চায়েত এলাকার গ্রামগুলিতে খুব কম সংখ্যক শৌচাগার নির্মিত হয়েছে, সেই সব গ্রামে পুতুল নাটকের মাধ্যমে মানুষদের বোঝানোর চেষ্টা প্রশাসন শুরু করে। তাতে ভাল মতোই সাড়া মিলছে বলে বিধানবাবুর দাবি। একই অভিজ্ঞতা সিউড়ি ১ ব্লকের বিডিও মুনমুন ঘোষ। তিনি বলছেন, “আমার ব্লকের মল্লিকপুর ও সিঙ্গুর গ্রামে ওই পুতুল নাটক দেখে বেশ কিছু মানুষ বাড়িতে শৌচাগার বানাতে অঙ্গীকারপত্রে স্বাক্ষর করেছেন!”
এমন একটি কাজে নিজেদের যুক্ত করতে পেরে গর্বিত ‘লাভপুর সংস্কৃতি বাহিনী’ও। কার্যত বিনা পয়সায় তাঁরা গ্রামে গ্রামে ঘুরে পুতুল নাটক দেখিয়ে সমাজকে শৌচাগারের ব্যাপারে সচেতন করছেন। তাঁরা কেবল যাতায়াতের ভাড়া নেন। উজ্জ্বলবাবু বলেন, “আমরা ইতিমধ্যেই ১৪টি পঞ্চায়েতে পুতুল সেজে নাটক করেছি। মোট ১৬৭টি গ্রাম পঞ্চায়েতে আমরা অনুষ্ঠান করব। তবে, যেখানেই নাটক করছি, প্রচুর মানুষ নাটকের শেষে আমাদের আবেদনে সাড়া দিচ্ছেন। শৌচাগার তৈরির জন্য অঙ্গীকারপত্রে স্বাক্ষরও করছেন। এটাই আমাদের প্রাপ্তি।”
২০১৭ সালের মধ্যে এ দেশকে নির্মল করার লক্ষ্য নিয়েছে কেন্দ্র সরকার। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও বারবারই বিভিন্ন জেলা প্রশাসনকে এ রাজ্যকে ৩১ মার্চের মধ্যে ‘নির্মল’ করার লক্ষ্যমাত্রা বেঁধে দিয়েছেন। আবার ইতিমধ্যেই এপিএল ও বিপিএল পরিবারে শৌচাগার নির্মাণের দিক থেকে বীরভূম নবম স্থানে রয়েছে। ইলামবাজার ব্লকের ৭টি পঞ্চায়েতে কাজ সম্পূর্ণ হয়েছে। তাদের ‘নির্মল পঞ্চায়েত’ হিসেবে ঘোষণাও করা হয়েছে। বিধানবাবু জানাচ্ছেন, তাঁরা ঠিক করেছেন তারও এক বছর আগেই এ জেলাকে ‘নির্মল বীরভূম’ রূপে ঘোষণা করতে পারবেন। হাতে রয়েছে আরও সাত মাস। এই পরিস্থিতিতে জেলার যে যে অংশে প্রকল্পের কাজ ঠিমেতালে চলছে, সেখানে মানব পুতুলদের পাঠিয়ে কাজে আরও গতি আনতে চাইছে বীরভূম জেলা প্রশাসন। এ ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট পঞ্চায়েতগুলিকে আরও বেশ করে দায়িত্ব নিতে হবে বলে মনে করছেন প্রকল্পের জেলা কো-অর্ডিনেটর উত্পলচন্দ্র পাল।
কী বলছেন অনঙ্গরা?
“মেয়েদের সম্ভ্রম রক্ষার জায়গাটা নিয়ে এমন ভাবে কেউ কখনও ভাবায়নি। পুতুলদের নাটক দেখে চোখ খুলল।” এ বার বাকিদেরও চোখ খোলার আশায় প্রশাসন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy