Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

টিকিট চেয়ে লম্বা লাইন তৃণমূলে

আনুষ্ঠানিক ভাবে পুরভোটের ঢাকে এখনও কাঠি পড়েনি। কিন্তু পুরভোটের আসন সংরক্ষণের চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশিত হয়ে গিয়েছে। সেই তালিকা ধরে এ বার নিজের নিজের এলাকায় ভোট যুদ্ধের ঘুঁটি সাজাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন পুরুলিয়া শহরের তৃণমূল নেতারা।

প্রশান্ত পাল
পুরুলিয়া শেষ আপডেট: ০৪ মার্চ ২০১৫ ০২:৩৪
Share: Save:

আনুষ্ঠানিক ভাবে পুরভোটের ঢাকে এখনও কাঠি পড়েনি। কিন্তু পুরভোটের আসন সংরক্ষণের চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশিত হয়ে গিয়েছে। সেই তালিকা ধরে এ বার নিজের নিজের এলাকায় ভোট যুদ্ধের ঘুঁটি সাজাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন পুরুলিয়া শহরের তৃণমূল নেতারা। পুরুলিয়া পুরসভায় এ বার একটি ওয়ার্ড বেড়ে ২২ থেকে ২৩টি হয়েছে। অতীতে ২০০৫-এ ২২ ওয়ার্ডের যুদ্ধে ডান-বাম দু’পক্ষ সমান সংখ্যক আসন পাওয়ায় টসে নিস্পত্তি হয় কোন পক্ষ পুরবোর্ডের দায়িত্ব সামলাবেন। পুরবাসীর মতে, ২৩টি ওয়ার্ড হওয়ায় এ বার তেমন পরিস্থিতি হলে আর টস করার প্রয়োজন হবে না।

সংরক্ষণের চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশের পর দেখা যাচ্ছে শাসক দলে প্রার্থী হওয়ার টিকিট নিতে লম্বা লাইন পড়ে গিয়েছে। বিদায়ী ও প্রাক্তন কাউন্সিলরদের সঙ্গে ওই লাইনে রয়েছেন দলের দীর্ঘদিনের নেতা-কর্মীরাও। দলে নতুন মুখেরাও লাইনে রয়েছেন। পুরনো নেতা-কর্মীদের কথায়, দলের দুর্দিনে বামফ্রন্টের বিরুদ্ধে তাঁর লড়াই করেছেন। তাই এখন তাঁরা পুরভোটের প্রার্থীর যোগ্য দাবিদার। আর নতুনদের বক্তব্য, বিদায়ী পুরবোর্ডে তো পুরনোরাই রয়েছেন। গত পাঁচ বছরে তাঁরা কেমন করছেন শহরে কান পাতলেন জানা যায়। তাই মানুষ এ বার তৃণমূলের নতুনদের উপরেই ভরসা রাখছেন। এক জেলা তৃণমূল নেতার কথায়, “২৩টি ওয়ার্ডের জন্য সব মিলিয়ে একশোর বেশিজন প্রার্থী হতে চাইছেন। এমন অবস্থা আহে কখনও হয়নি।”

তৃণমূল সূত্রে জানা গিয়েছে, ১ নম্বর ওয়ার্ডে গতবার বামফ্রন্টের প্রার্থী জয়ী হলেও এ বারও ওই ওয়ার্ডে লড়তে চাইছেন গতবারের প্রতিদ্বন্দ্বী অনিমা মাহাতো। তাঁর সঙ্গে শোনা যাচ্ছে বিষ্ণু সহিস, দলের শিক্ষক সংগঠনের নেতা গোপাল দাসের নামও। ২ নম্বর ওয়ার্ডে জেতে কংগ্রেস। এ বার এই ওয়ার্ডে তৃণমূলের টিকিটের দাবিদার সুজাতা দাস-সহ আরও দু-একজন মহিলা কর্মী। ৩ নম্বর ওয়ার্ডে গতবার তৃণমূলের সুনয় কবিরাজ জিতেছিলেন। এ বার ওয়ার্ডটি মহিলা সংরক্ষিত হওয়ায় সুনয়বাবুর স্ত্রী রুম্পা কবিরাজ নাকি অনামিকা ত্রিপাঠী, কাকে প্রার্থী করা হয় তা নিয়ে বেশ আগ্রহ রয়েছে এলাকায়। বিদায়ী কাউন্সিলর সুনয়বাবু অবশ্য আগেই বলে রাখছেন, “প্রার্থীপদ ঘোষণা করার আগে কাজের বিচার হওয়া দরকার।” তবে এই ওয়ার্ডের বাসিন্দা পুরুলিয়ার বিধায়ক তথা দলের প্রাক্তন জেলা সভাপতি কে পি সিংহ দেও-র। দল সূত্রের খবর, তিনি যাঁকে চাইবেন এখানে তাঁকেই প্রার্থী করা হবে। ৪ নম্বর ওয়ার্ডে গতবার জয়ী হয়েছিলেন তৃণমূলের পাপিয়া দাস। এ বারও তিনি দাবিদার রয়েছেন। এই ওয়ার্ডেই অন্য দাবিদার রয়েছেন মন্ত্রী তথা দলের জেলা সভাপতি শান্তিরাম মাহাতোর ঘনিষ্ঠ অনঙ্গ দাস। তিনি পাড়া কেন্দ্রের প্রাক্তন বিধায়ক শরৎ দাসের ছেলে। তাঁর পরিবার দীর্ঘদিন ধরেই বাম বিরোধী রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। এই ওয়ার্ড কমিটির সভাপতি গৌর মাহাতোও প্রার্থী পদের অন্যতম দাবিদার।

শহরের অভিজাত পাড়াগুলির অন্যতম ৫ নম্বর ওয়ার্ড। এখানে বিগত দু’বারই জয়ী হয়েছেন কংগ্রেসের বিভাস দাস। বিদায়ী বোর্ডে তিনি বিরোধী দলনেতা। এখানে তৃণমূলের টিকিটের জন্য দাবি জানাচ্ছেন বিধায়কের ঘনিষ্ঠ প্রদীপ দাগা, দলের পুরনো কর্মী আদিত্য মণ্ডল, দেবাশিস মুখোপাধ্যায় ও শিক্ষক সেলের নেত্রী নির্মলা মাহাতো। এই ওয়ার্ডে নতুনদের মধ্যেও কয়েকজন লাইন দিয়েছেন। পাশের ৬ নম্বর ওয়ার্ডে গতবার জিতেছিল বামফ্রন্ট। এই ওয়ার্ড মহিলা সংরক্ষিত হওয়ায় টিকিটের দাবি জানিয়েছেন, শহর মহিলা তৃণমূল নেত্রী মৌসুমী ঘোষ। দাবিদার হিসেবে উঠে এসেছে জেলা সভাধিপতি সৃষ্টিধর মাহাতোর ঘনিষ্ঠ এক দলীয় কর্মীর স্ত্রী-র নাম। ওই কর্মীর কথায়, “দলের জন্মলগ্ন থেকেই রয়েছি। দেখি দল কী ঠিক করে।”

৭ নম্বর ওয়ার্ডের দিকে তাকিয়ে অনেকেই। এখানেও দাবিদার মৌসুমীদেবী। ২০০৯-র উপনিবার্চনে এই ওয়ার্ডে দলের টিকিট না পেয়ে নির্দল প্রার্থী হিসেবে তিনি লড়াই করে জেতেন। পরে তৃণমূলে ফেরেন তিনি। তবে মৌসুমীদেবীর ঘনিষ্ঠ মহল চাইছে, তিনি মহিলা সংরক্ষিত ৬ নম্বরেই প্রতিদ্বন্দ্বিতা করুন। ৭ নম্বরের দাবিদার দলের বর্ষীয়ান সদস্য তথা বেঙ্গল চেম্বার অব ট্রেড এন্ড ইন্ডাস্ট্রিজের পুরুলিয়া জেলা সম্পাদক গোবিন্দ মুখোপাধ্যায়। গতবার তিনি লড়েছিলেন ৬ নম্বর ওয়ার্ডে। ওয়ার্ডটি সংরক্ষণের গেরোয় পড়ায় তিনি এ বার ৭ নম্বরে নামতে চাইছেন। এই ওয়ার্ডেই দাবি জানাচ্ছেন দলের পুরনো কর্মী শম্ভু সরকার, শহর যুব তৃণমূল নেতা রাণাপ্রতাপ সিংহ ও দলের আর এক কর্মী হারু দাস। শম্ভুবাবু নিজের পক্ষে সমর্থন চেয়ে ইতিমধ্যেই সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটে পোস্টও করেছেন। পাশের আট নম্বর ওয়ার্ড সংখ্যালঘু অধ্যুষিত। এই ওয়ার্ডে তৃণমূল প্রভাবিত শ্রমিক সংগঠনের কর্মী সেখ সাহিদ-সহ একাধিক নেত-কর্মীর নাম শোনা যাচ্ছে।

নজরে থাকা আর একটি ওয়ার্ড হল ১২ নম্বর। গতবার এই ওয়ার্ড থেকেই নির্বাচিত হয়েছিলেন পুরপ্রধান তারকেশ চট্টোপাধ্যায়। এ বার ওয়ার্ডটি সংরক্ষিত হয়েছে। তাই দাবিদারও একাধিক। নাম উঠে এসেছে মাণিক রজক, বাবলু বাউরি, দীপক কর্মকার, সমীর বাউরি, রঞ্জিত কর্মকার, শক্তি কর্মকার-সহ কয়েকজন নেতা-কর্মীর। ১৩ ও ১৪ নম্বর দু’টি ওয়ার্ডই সাধারণ। ১৩ নম্বরে এ বারও দাবিদার বিদায়ী কাউন্সিলর প্রদীপ মুখোপাধ্যায় (বিল্টু)। দলের দীর্ঘদিনের নেতা সুদীপ মুখোপাধ্যায়ও এ বার এই দু’টি ওয়ার্ডের একটি থেকে লড়তে চান বলে তাঁর ঘনিষ্ঠ মহল সূত্রে জানা যাচ্ছে। সুদীপবাবুর সঙ্গে জেলা সভাপতির দূরত্বের কথা সর্বজনবিদিত হলেও সম্প্রতি তাঁর বৌভাতে শান্তিরামবাবুর উপস্থিতি জ্বল্পনা বাড়িয়েছে কর্মীদের মধ্যে।

নজরে রয়েছে ১৬ নম্বর ওয়ার্ডও। এখানে এ বার দাবিদার রয়েছেন বিদায়ী কাউন্সিলর তথা শহর কমিটির নেতা বৈদ্যনাথ মণ্ডল, শহর যুব তৃণমূল নেতা কাজল বন্দ্যোপাধ্যায় ও কৃষ্ণেন্দু মাহালি। তারকেশবাবু অতীতে ১৭ নম্বর ওয়ার্ড থেকে জিতেছিলেন। এ বারও তিনি এই ওয়ার্ডে প্রার্থী হতে পারেন বলে শোনা যাচ্ছে। সেই সঙ্গে সলিল নন্দী, তৃষ্ণা মিত্র, বিশ্বনাথ নন্দীর নামও ঘোরাফেরা করছে বিভিন্ন মহলে। ১৯ নম্বর ওর্য়াডে জেলা যুব তৃণমূল সভাপতি গৌতম রায়, মহিলা সংগঠনের নেত্রী ছায়া দাস, শহর কমিটির নেতা বৈদ্যনাথ মণ্ডলের সঙ্গে মাণিক রজক ও নীলু ধীবরের নাম শোনা যাচ্ছে। বিদায়ী উপ পুরপ্রধান সামিমদাদ খানের নিজের ওয়ার্ডটি (১০ নম্বর) এ বার সংরক্ষণ বিভিন্ন ওয়ার্ড থেকে এত বিপুল সংখ্যক নেতা-কর্মী নির্বাচনে নামতে আগ্রহ দেখাচ্ছেন যে বিশেষ কয়েকটি ওয়ার্ডে কাকে ছেড়ে কাকে রাখবেন তা ঠিক রীতিমত বেগ পেতে হবে বলে মানছেন দলের জেলা শীর্ষ নেতারাই। জেলা সভাপতি শান্তিরাম মাহাতো বলেন, “বিভিন্ন ওয়ার্ডে একাধিক নাম আসছে। এলাকায় গ্রহণযোগ্যতা বিচার করেই প্রার্থী ঠিক করা হবে।” তবে বিদায়ী কাউন্সিলররা এ বারেও টিকিট পাচ্ছেন কি না সে প্রশ্ন এড়িয়ে গিয়েছেন তিনি। তাঁর কথায়, “নতুন পুরনো মিলিয়েই প্রার্থী ঠিক করা হবে।” দলের আর এক বর্ষীয়ান নেতা কেপি সিংহ দেও বলেন, “এখনও কিছুই ঠিক হয়নি। বিভিন্ন ওয়ার্ড থেকে নাম আসছে। দলীয় বৈঠকেই প্রার্থী তালিকা ঠিক করা হবে।” গত লোকসভা ভোটে তৃণমূল প্রার্থী জয়ী হলেও দলের ভোট কমেছিল পুরুলিয়া পুরএলাকায়। পাশাপাশি গত পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকার ফলে প্রতিষ্ঠান বিরোধী হাওয়াও তৃণমূলের বিরুদ্ধে একটা ‘ফ্যাক্টর’ হিসেবে থাকছে। তার উপরে পুরপরিষেবা নিয়েও বর্তমান বোর্ডের বিরুদ্ধে নানা মহলে অসন্তোষ রয়েছে। তাই দলের কর্মীদের একাংশের মতে, টিকিট নেওয়ার জন্য এত লড়াই করে আখেরে প্রার্থীরা লোকসভার তুলনায় শহরে দলের ভোটপ্রাপ্তি বাড়াতে পারবেন কি না তা নিয়ে সংশয় রয়েছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

prasanta pal purulia municipal vote tmc
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE