Advertisement
১৭ এপ্রিল ২০২৪

দু’পাড়ের দূরত্ব ঘুচবে কবে, প্রশ্ন

দুই গ্রামের মাঝে কয়েকশো মিটার চওড়া একটা নদী। অথচ বছরের প্রায় বেশ কয়েক মাস এই কয়েকশো মিটার পার করতে মানুষজনকে ঘুরতে হয় প্রায় ৩০ কিলোমিটার পথ! ব্লক সদর, স্বাস্থ্যকেন্দ্র, থানা, রেল স্টেশন, ব্লকের বাজার-সহ নানা সুবিধা থেকে বঞ্চিত থাকেন অন্য পাড়ের বাসিন্দারা। দীর্ঘকালের এই সমস্যায় এখনও একই ভাবে দুর্ভোগে ওন্দা ব্লকের একাংশের বাসিন্দা।

দ্বারকেশ্বর নদের উপরে সেতু আজও হল না। শুখা মরসুমের এই অস্থায়ী রাস্তা বর্ষায় ভেসে যায়। বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় দু’পাড়। ছবি: অভিজিত্‌ সিংহ।

দ্বারকেশ্বর নদের উপরে সেতু আজও হল না। শুখা মরসুমের এই অস্থায়ী রাস্তা বর্ষায় ভেসে যায়। বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় দু’পাড়। ছবি: অভিজিত্‌ সিংহ।

রাজদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়
ওন্দা শেষ আপডেট: ১১ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ ০২:০৫
Share: Save:

দুই গ্রামের মাঝে কয়েকশো মিটার চওড়া একটা নদী। অথচ বছরের প্রায় বেশ কয়েক মাস এই কয়েকশো মিটার পার করতে মানুষজনকে ঘুরতে হয় প্রায় ৩০ কিলোমিটার পথ!

ব্লক সদর, স্বাস্থ্যকেন্দ্র, থানা, রেল স্টেশন, ব্লকের বাজার-সহ নানা সুবিধা থেকে বঞ্চিত থাকেন অন্য পাড়ের বাসিন্দারা। দীর্ঘকালের এই সমস্যায় এখনও একই ভাবে দুর্ভোগে ওন্দা ব্লকের একাংশের বাসিন্দা।

দ্বারকেশ্বর নদকে কেন্দ্র করেই প্রাচীন কালে বসতি গড়ে উঠেছিল বর্তমান ওন্দা ব্লকে। জেলার সবচেয়ে বড় এই ব্লকের মাঝ বরাবর বয়ে চলেছে দ্বারকেশ্বর। সেতু না থাকায় নদের ওপারের বহু গ্রামের সঙ্গেই বছরের বিভিন্ন সময় যোগাযোগ বন্ধ হয়ে থাকে ব্লক সদরের। এই ঘটনার সমাধানে ওন্দার চাপড়া ও গামিদ্যা গ্রামের মধ্যে সেতু গড়ার দাবি দীর্ঘ দিন ধরে জানিয়ে আসছেন সাধারণ মানুষজন। প্রশাসনের আধিকারিক থেকে জনপ্রতিনিধিরা দীর্ঘদিন ধরে ‘হচ্ছে-হবে’ বলে আশ্বাস দিয়ে আসছেন। অথচ সেতুর একটি ইট এতদিনেও গাঁথা হয়নি।

গামিদ্যা, মাজডিহা, দানারডিহি, ভেদুয়া, ওলা, সাহাপুর, নিকুঞ্জপুরের মতো একাধিক গ্রাম দ্বারকেশ্বরের ওপারে। নদ পার হয়ে ব্লক সদরে আসতে হলে তাদের চাপড়া হয়ে আসতে হয়। কিন্তু সেতু না থাকায় বর্ষার সময় থেকে বেশ কয়েক মাস নদীর উপর দিয়ে সহজে যাতায়াত করা যায় না। বর্ষার জল নামলে গ্রামবাসীই বালির বাঁধ দিয়ে নদীতে অস্থায়ী সেতু গড়ে যাতায়াত করেন। বছরের বাকি কয়েক মাস গ্রামবাসীর একমাত্র ভরসা বাঁশের ভেলা। কিন্তু চাপড়া-সহ নদীর এ পারের বহু গ্রামের কৃষিজীবী পরিবারের জমিই রয়েছে নদীর ওপারে গামিদ্যা-সহ বিভিন্ন গ্রামে। ভেলায় করে গরু-মোষ নিয়ে যাওয়া কার্যত অসম্ভব। প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে ভেলায় পারাপার করতে গিয়ে জলে ডুবে মৃত্যুর ঘটনাও ঘটেছে এখানে।

অন্য দিকে, ওপারের গ্রামগুলির কৃষক পরিবার তাদের উত্‌পাদিত ফসল বিক্রির জন্য ওন্দা বাজারের দিকেই তাকিয়ে থাকেন। আবার সব্জি অন্যত্র পাঠাবার জন্যও রেলপথের দরকার পড়ে। যার জন্য তাঁদের ওন্দা আসতেই হবে। কিন্তু যোগাযোগ ব্যবস্থা না থাকায় তা হয়ে ওঠে না। ফলে বৃহত্তর বাজার হাতছাড়া হয় ওই কৃষক পরিবারগুলির।

দীর্ঘদিনের অবহেলা ও মিথ্যা প্রতিশ্রুতিতে এখন আর ভরসা করতে নারাজ স্থানীয় বাসিন্দারা। চাপড়ার বাসিন্দা সৃষ্টিধর ঘোষের কথায়, “গামিদ্যায় আমার জমি। বর্ষায় নদী পার হয়ে গ্রামে যেতে জীবনের ঝুঁকি নিতে হয়। চোখের সামনে অনেককেই ভেসে যেতে দেখেছি।” চাপড়ার বাসিন্দা পেশায় ফেরিওয়ালা সৌরভ খানের বক্তব্য, “নদের ওপারে অনেক ক্রেতা আছেন। কিন্তু বছরের অর্ধেক সময় তো সেখানে যেতেই পারি না। আমাদের আর্থিক ক্ষতির কথা কে ভাবে?” কৃষিজীবীদের আক্ষেপ, “দুই পাড়ের মধ্যে একটা সেতু হলে এলাকার অর্থনৈতিক ছবিটাই বদলে যেত। কিন্তু সরকার আসে-যায়, আমাদের দাবি আর পূরণ হয় না।”

অন্যান্য সমস্যাও রয়েছে।

সেতু না থাকায় নদ পার হতে ওপারের রোগীরাও সমস্যায় পড়েন। নদে যখন জল থাকে, তখন রাতবিরেতে কেউ সামান্য অসুস্থ হয়ে পড়লে তাঁকে ঘুরপথে বাঁকুড়া মেডিক্যালে নিয়ে যেতে হয়। বাসিন্দাদের ক্ষোভ, অথচ সেতু থাকলে অনেক কম সময়ে ওন্দা ব্লক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যাওয়া যেত। গামিদ্যার বাসিন্দা গুরুপদ বিশ্বাস বলছেন, “কোনও দুর্ঘটনা ঘটলে পুলিশ ডাকতে পারি না। কেউ অসুস্থ হয়ে গেলে হাসপাতালে নিয়ে যেতে পারি না। একটা সেতু গড়ে দিলে এই সব সমস্যা মিটে যেত।” পুলিশের পক্ষেও দ্রুত নদের ওপারের ওই গ্রামগুলিতে পৌঁছনো অসম্ভব। প্রশাসনিক আধিকারিকদেরও নদীর ওপারের গ্রামগুলির সঙ্গে যোগাযোগ রাখা দুরুহ হয়ে পড়েছে। এই পরিস্থিতিতে দ্বারকেশ্বর নদের উত্তর পাড়ের গ্রামগুলির বাসিন্দারা বঞ্চনার অভিযোগ তুলেছেন। বাসিন্দাদের কথায়, সমস্যার কথা বলতে গেলেই নেতা, সরকারি অফিসাররা সবাই বলে খুব তাড়াতাড়ি সেতু হয়ে যাবে। ওঁদের কথাতেই সেতু হচ্ছে, বাস্তবে কিছুই হচ্ছে না।

নিজেদের খামতির কথা মেনেও নিচ্ছেন ফরওয়ার্ড ব্লকের জেলা নেতা মাণিক মুখোপাধ্যায়। তিনি নিজেও ওই এলাকার বাসিন্দা। তাঁর আক্ষেপ, “এই অসুবিধার জন্য নিকুঞ্জপুর ও সাহারজোড়া গ্রাম পঞ্চায়েতের একাংশকে বাঁকুড়া ২ ব্লকের সঙ্গে যুক্ত করার দাবি বাম আমলে তুলেছিলাম আমরা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা করে উঠতে পারিনি। চাপড়া- গামিদ্যা সেতু গড়ার দাবিও জানিয়েছিলাম। কিন্তু সরকার সাড়া দেয়নি।” বর্তমান তৃণমূল সরকারের প্রথম সাড়ে তিন বছরেও সেতু গড়ার কাজ শুরু হয়নি।

তবে সেতু গড়ার আশ্বাস দিয়েছেন ওন্দার বিধায়ক তথা জেলা তৃণমূল সভাপতি অরূপ খাঁ। তাঁর কথায়, “মাটি পরীক্ষা থেকে শুরু করে সেতুর যাবতীয় পরিকল্পনা গড়া হয়ে গিয়েছে। জেলা থেকে রাজ্যকে পরিকল্পনার খসড়া পাঠানো হয়েছে। টাকা বরাদ্দ হলেই কাজ শুরু করা হবে।” ওন্দার বিডিও শুভঙ্কর ভট্টাচার্যের কথা, “জেলা সেচ দফতর সেতু গড়ার পরিকল্পনা খসড়া তৈরি করেছে। জেলা থেকে রাজ্য সেচ দফতরে তা পাঠানো হয়েছে। আনুমানিক ৪২ কোটি টাকার প্রকল্প। অর্থ বরাদ্দ কবে হয় সে দিকেই আমরা তাকিয়ে।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

amar shohor onda bridge rajdeep bandopadhay
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE