Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪
এবিভিপি-কে রুখল টিএমসিপি

পুরো ‘টিম’ নামিয়েই কলেজে ৬-০

কলেজ দখলে রাখতে টিএমসিপি-র সঙ্গে যুব তৃণমুলকেও ছাত্রসংসদ নির্বাচনে নামতে বলেছিল দল। কিন্তু মনোনয়ন পত্র তোলার দিনে দেখা গেল শুধু যুব সংগঠনই নয়, টিএমসিপি-র সঙ্গে কোমর বেঁধে রাস্তায় নামলেন তৃণমূল নেতারাও। যার জেরে বাঁকুড়া সদর মহকুমার কলেজ সংলগ্ন এলাকায় দিনভর উত্তেজনা ছড়াল। অধিকাংশ কলেজেই বহিরাগতদের দিয়ে টিএমসিপি তাদের ছাত্র সংগঠনের প্রার্থীদের মারধর করে তাড়িয়ে দিয়েছে বলে অভিযোগ তুললেন বাঁকুড়ার এবিভিপি নেতারা।

গোলমালের পরে বাঁকুড়ার ভৈরবস্থানে পুলিশের টহল। —নিজস্ব চিত্র

গোলমালের পরে বাঁকুড়ার ভৈরবস্থানে পুলিশের টহল। —নিজস্ব চিত্র

নিজস্ব সংবাদদাতা
বাঁকুড়া শেষ আপডেট: ০৩ জানুয়ারি ২০১৫ ০০:৫৭
Share: Save:

কলেজ দখলে রাখতে টিএমসিপি-র সঙ্গে যুব তৃণমুলকেও ছাত্রসংসদ নির্বাচনে নামতে বলেছিল দল। কিন্তু মনোনয়ন পত্র তোলার দিনে দেখা গেল শুধু যুব সংগঠনই নয়, টিএমসিপি-র সঙ্গে কোমর বেঁধে রাস্তায় নামলেন তৃণমূল নেতারাও। যার জেরে বাঁকুড়া সদর মহকুমার কলেজ সংলগ্ন এলাকায় দিনভর উত্তেজনা ছড়াল। অধিকাংশ কলেজেই বহিরাগতদের দিয়ে টিএমসিপি তাদের ছাত্র সংগঠনের প্রার্থীদের মারধর করে তাড়িয়ে দিয়েছে বলে অভিযোগ তুললেন বাঁকুড়ার এবিভিপি নেতারা। প্রতিবাদে পথ অবরোধ করতে গেলে বাঁকুড়ার ভৈরবস্থান এলাকায় দুই এবিভিপি সমস্যকে মারধর করা হয় বলেও অভিযোগ। দিনের শেষে বাঁকুড়া মহকুমার এ দিন যে ছ’টি কলেজে মনোনয়নপত্র তোলা চলছিল, সেই সব ক’টিকেই ‘বিরোধী শূন্য’ করতে সক্ষম হল টিএমসিপি।

পুরুলিয়ার হুড়া মহাত্মা গাঁধী কলেজের ছাত্র সংসদ আরএসএস প্রভাবিত ছাত্র সংগঠন অখিল ভারতীয় বিদ্যার্থী পরিষদ (এবিভিপি)-এর কাছে হারানোয় সিঁদুরে মেঘ দেখেছিল পাশের বাঁকুড়া জেলা তৃণমূল নেতৃত্ব। তাই কলেজে ক্ষমতা ধরে রাখতে টিএমসিপি-র পাশাপাশি যুব তৃণমূলের জেলা সভাপতি শিবাজী বন্দ্যোপাধ্যায়কেও ভোটে ঝাঁপিয়ে পড়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন তৃণমূলের জেলা সভাপতি অরূপ খাঁ। শিবাজীর নেতৃত্বে আগে বহু কলেজেই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়লাভ করেছে টিএমসিপি। ঘটনাচক্রে সব ক্ষেত্রেই সন্ত্রাস চালানোর অভিযোগ উঠেছিল টিএমসিপি-র বিরুদ্ধে। ফের শিবাজির হাতে কলেজ ভোটের ভার ছেড়ে দেওয়ায় সন্ত্রাসের পরিবেশ ফিরে আসবে বলে আগেই আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন জেলা বিজেপি নেতারা। এ দিন তাঁরা দাবি করেছেন, তাঁদের আশঙ্কাই এ দিন সত্যি হল।

প্রশাসন সূত্রে খবর, শালতোড়ার নেতাজি সেন্টিনারি কলেজ, গঙ্গাজলঘাটির গোবিন্দপ্রসাদ মহাবিদ্যালয়, বেলিয়াতোড়ের যামিনী রায় কলেজ, বড়জোড়া কলেজ, ওন্দা মহাবিদ্যালয় ও বাঁকুড়ার সম্মিলনী কলেজে এ দিন মনোনয়ন পত্র তোলার প্রথম ও শেষ দিন ছিল। বেলিয়াতোড় কলেজ বাদে বাকি সব ক’টি কলেজেই এবিভিপি প্রার্থী দেবে বলে ঠিক করেছিল। সেই মোতাবেক সমস্ত প্রস্তুতিও সারা হয়ে গিয়েছিল। অভিযোগ, এ দিন তৃণমূলের সঙ্গে যুব তৃণমূল ও টিএমসিপি-র মিলিত প্রতিরোধে কোনও কলেজেই ঢুকতে পারেনি ওই ছাত্রসংগঠনের ছেলেরা।

এ দিন সকাল থেকেই নেতাজি সেন্টিনারি কলেজে এবিভিপি এবং এসএফআই-এর ছেলেদের ঢোকা আটকাতে শালতোড়া বাজারেই কয়েকশো সশস্ত্র তৃণমূল কর্মী জমায়েত করে বলে অভিযোগ। পরে দুই বিরোধী সংগঠনের ছেলেরা মনোনয়নপত্র তুলতে কলেজের দিকে পা বাড়াতেই তাদের রাস্তায় আটকে মারধর করা হয় বলে অভিযোগ। এবিভিপির ছেলেদের কয়েকটি গাড়িও ভাঙচুর করা হয়। এই ঘটনার পরে পিছু হটেন দুই সংগঠনের সদস্যেরাই। পরে এবিভিপি-র কয়েকজন সদস্য শালতোড়া থানায় গিয়ে অল্পক্ষণের জন্য ধর্নায় বসেন।

একই ভাবে গঙ্গাজলঘাটির গোবিন্দ প্রসাদ মহাবিদ্যালয়ের দরজার সামনে কয়েকশো তৃণমূল কর্মী জটলা পাকিয়ে থাকেন। এবিভিপি-র ছেলেরা কলেজে ঢুকতে গেলে তাঁদের মারধর করে বের করে দেওয়া হয় বলে অভিযোগ। মনোনয়নপত্র তুলতে না পেরে গঙ্গাজলঘাটি বাজারে প্রায় এক ঘণ্টা পথ অবরোধ করেন তাঁরা। একই ভাবে বড়জোড়া কলেজেও মূল দরজায় জমায়েত করে তৃণমূল কর্মীরা। জমায়েত দেখে এসএফআই-এর ছেলেরা মনোনয়নপত্র না তোলার সিদ্ধান্ত নিয়ে পিছু হটে। এবিভিপি-র ছেলেরা কলেজে ঢুকতে গেলে ব্যাপক গণ্ডগোল বাঁধে। শুরু হয় হাতাহাতি। বেশ কিছু এবিভিপি-র ছেলেকে তৃণমূলের লোকজন তাড়া করে বলে অভিযোগ। এর জেরে পরে বিজেপির বড়জোড়া ব্লক কার্যালয়েও ভাঙচুর চালানো হয় বলে অভিযোগ তুলেছে বিজেপি। তাঁদের অভিযোগ, দিনভর এ সব চললেও প্রশাসন বা পুলিশকে বিরোধী ছাত্র সংগঠনের ইচ্ছুক প্রার্থীদের কলেজে নিয়ে গিয়ে মনোনয়ন পত্র জমা দিতে নিরাপত্তা দিতে দেখা যায়নি।

ছাত্রসংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে কয়েক সপ্তাহ আগেই এবিভিপি ও টিএমসিপির সংঘর্ষে উত্তেজনা ছড়ায় ওন্দা মহাবিদ্যালয়ে। মনোনয়নপত্র তোলার দিন তাই এই কলেজে বিরাট সংখ্যায় পুলিশ মোতায়েন ছিল। কিন্তু তাতেও অশান্তি এড়ানো যায়নি। বেলা সাড়ে ১১টা নাগাদ এবিভিপি-র ছেলেরা কলেজের ভিতরে ঢুকতেই তেতে ওঠে পরিস্থিতি। মনোনয়নপত্র টিএমসিপি-র প্রার্থীরা তোলার পরেই গোলামাল বেঁধে যায় বলে অভিযোগ। কলেজ চত্বরেই টিএমসিপির ছেলেরা ভাঙচুর শুরু করে। কমব্যাট ফোর্স কলেজের ভিতরে ঢুকে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে লাঠি চালায় বলেও অভিযোগ। টিএমসিপির অভিযোগ, লাঠির আঘাতে জখম হন কলেজের তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী পূজা বড়াল। তাঁকে ব্লক স্বাস্থ্য কেন্দ্রে নিয়ে গিয়ে প্রাথমিক চিকিত্‌সা করানো হয়। ওন্দা পঞ্চায়েত সমিতির কর্মাধ্যক্ষ ভবানী মোদকের দাবি, “পূজা টিএমসিপির প্রার্থী। কমব্যাট ফোর্সের লাঠির আঘাতে তিনি জখম হয়েছেন।” কলেজে গোলমালের খবর পেয়ে সেখানে যান ডিএসপি (শৃঙ্খলা ও প্রশিক্ষণ) বাপ্পাদিত্য ঘোষ। কলেজ কর্তৃপক্ষ মনোনয়নপত্র বিলির পর্ব বন্ধ করে দেওয়ার কথা ঘোষণা করেন। শেষ পর্যন্ত এবিভিপি না পারলেও এই কলেজে এসএফআই-এর তিনজন প্রার্থী মনোনয়ণপত্র তুলতে পেরেছে বলে জানিয়েছেন দলের জেলা সম্পাদক ধর্মেন্দ্র চক্রবর্তী।

বাঁকুড়া সম্মিলনী কলেজেও এ দিন এবিভিপির কর্মীদের আটকাতে কলেজের দরজার সামনে জটলা করেন তৃণমূল কর্মীরা। কলেজে ঢুকতে গেলে এবিভিপি-র কর্মীদের মারধর করে বের করে দেওয়া হয় বলে অভিযোগ। শেষে কলেজে ঢুকতে না পেরে শহরের ভৈরবস্থান মোড়ে পথ অবরোধ করেন এবিভিপির সদস্যেরা। সেখানেও টিএমসিপির কর্মীরা তাঁদের লাঠি পেটা করে সরিয়ে দেয় বলে অভিযোগ। ঘটনায় জখম হন এবিভিপি সদস্য গৌতম কালী ও দেবু দত্ত। দু’জনকেই বাঁকুড়া মেডিক্যালে ভর্তি করা হয়। গোলমালের পরে সেখানে যায় কমব্যাট ফোর্স।

যদিও জেলা পুলিশ সুপার মুকেশ কুমার দাবি করেছেন, “প্রতিটি কলেজেই বিশাল পরিমাণ পুলিশ মোতায়েন ছিল। তাই ঝামেলা এড়ানো গিয়েছে। কোনও দলই মনোনয়ণপত্র তুলতে বাধা পেয়েছেন বলে লিখিত অভিযোগ থানায় দায়ের করা হয়নি। কোথাও লাঠিচার্জও করা হয়নি।” এ দিকে কোনও কলেজেই মনোনয়নপত্র তুলতে না পেরে আইনি ব্যবস্থার পথে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে এবিভিপি। সংগঠনেরর জেলা সাধারণ সম্পাদক অনুপ সাহা অভিযোগ করেন, “গণতন্ত্রকে হত্যা করা হল এ দিন। পুলিশ নীরব দর্শকের মতো দাঁড়িয়ে আমাদের কর্মীদের মার খেতে দেখল। আমরা এই মনোনয়নপত্র বিলির প্রক্রিয়া বাতিলের দাবিতে আদালতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।”

অন্য দিকে, তৃণমূলের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ অস্বীকার করেছেন জেলা তৃণমূল সভাপতি অরূপ খাঁ। তিনি বলেন, “অবাধ ও শান্তিপূর্ণভাবে মনোনয়নপত্র বিলি হয়েছে। কোথাও তৃণমূল ঝামেলা করেনি। এবিভিপির ছেলেরাই গণ্ডগোল পাকানোর চেষ্টা করেছিল বিভিন্ন জায়গায়।” এসএফআই-এর জেলা সম্পাদক ধর্মেন্দ্রবাবুর অভিযোগ, “বিরোধীরা যাতে মনোনয়ণপত্র তুলতে না পারে, সে জন্যই পরিকল্পনা করে একদিন মাত্র মনোনয়নপত্র বিলি করা হয়েছে। আমরা এই ঘটনার প্রতিবাদ জানিয়েছি।”

আজ শনিবার বিষ্ণুপুর ও খাতড়া মহকুমার কলেজগুলিতে মনোনয়নপত্র বিলি করার কথা। এ দিনও একই রকম ঝামেলার আশঙ্কা করছে এসএফআই এবং এবিভিপি। তৃণমূল সূত্রে খবর, শুক্রবারই সারেঙ্গায় একটি সভায় জঙ্গলমহলের চারটি ব্লকের টিএমসিপি, যুব তৃণমূল ও তৃণমূল নেতাদের ডেকে ‘এবিভিপিকে কলেজে ঢুকতে না দেওয়া’র নির্দেশ দিয়ে এসেছেন যুব তৃণমূলের সভাপতি। তিনি এ দিন প্রকাশ্যেই বলেন, “জঙ্গলমহলের কলেজে এবিভিপিকে রুখতে আমি ‘ফিল্ডার’ সাজিয়েই এসেছি। কোনও সাম্প্রদায়িক দলকে কলেজে আমরা ঢুকতে দেব না।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

bankura tmcp abvp student union election
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE